![]() |
ছবি: সংগৃহীত |
পৃথিবীর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবহনব্যবস্থাও আধুনিকায়ন হচ্ছে। উন্নত হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থা। যোগাযোগব্যবস্থার এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় রেলওয়ে তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় রেলওয়ের স্বর্ণযুগ। উন্নত দেশগুলোতে পরিবহনব্যবস্থায় রেলওয়ে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। রেলওয়ে হচ্ছে নিরাপদ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী পরিবহনব্যবস্থা। জাপান, ভারতসহ ৫৫টি দেশের ১৮০টি শহর পুরোপুরি রেলনির্ভর যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এসব শহরে মেট্রোরেল পরিবহনব্যবস্থাকে সহজীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। মেট্রো সিস্টেমকে বলা হয় পরিবহনের শেষ দাওয়াই। যানজটের সময় অন্য যেসব পরিবহন সড়কে চলাচল করে, তাদের সবার সঙ্গে শেয়ার করে চলতে হয়। কিন্তু মেট্রোরেল এমনই এক পরিবহনব্যবস্থা, যাকে অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করে চলতে হয় না। অর্থাত্, রেল অনেকটাই স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। ফলে রেলেভ্রমণ তুলনামূলকভাবে কম বিড়ম্বনামূলক। পিক আওয়ারে রাস্তায় যখন প্রচণ্ড যানজট তৈরি হয়, তখন মেট্রোরেল দ্রুত চলাচলের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। আমরা পিক আওয়ারে গণপরিবহনের যে নির্ভরশীলতার কথা বলি, সময়োপযোগী পরিবহনব্যবস্থার কথা বলি, সেটা শুধু মেট্রোরেল যোগাযোগব্যবস্থাতেই পাওয়া সম্ভব।
রাজধানী ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা এমনিতেই খুব নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। মূলত এ কারণেই নগরবাসীর জন্য যানজটমুক্ত সহজ চলাচলব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখানে মোট ছয়টি মেট্রোরেল লাইন স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি আধুনিক সড়কনির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে দুটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইনের কথা বলা হয়েছে। গণপরিবহনব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনার আলোকেই রাজধানী শহর ঢাকায় মেট্রোরেল লাইন নির্মিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১১ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার রাস্তা আছে, সেখানে মেট্রোরেল চলাচল করছে। মেট্রোরেল এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। বর্তমানে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার যাত্রী প্রতিদিন মেট্রোরেলে যাতায়াত করছে। আবার বাস র্যাপিড ট্রানজিট এ বছরই উদ্বোধন করা হবে। গাজীপুর থেকে উত্তরা পর্যন্ত নির্মিত প্রায় ২০ কিলোমিটার বিশেষায়িত লেনে বাস চলাচল করবে। তবে আমাদের নগর উন্নয়নের একটি বিশেষ দর্শন আছে। দর্শনটি হচ্ছে, নগরের যানজট কার্যকরভাবে কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হলে পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন হতে হবে ধাপে ধাপে। এর প্রথম ধাপটিই হচ্ছে সঠিক ফুটপাতের ব্যবস্থাপনা। এর পরে আছে সিটি বাস সার্ভিসের বিষয়টি। তারপর বাস র্যাপিড ট্রানজিট এবং সর্বশেষ দাওয়াই হচ্ছে মেট্রোরেল। আমরা মেট্রোরেল চলাচলের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি, কিন্তু ফুটপাত ব্যবস্থাপনা ও সিটি বাস সর্ভিসকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাত কার্যত অবহেলিত অবস্থায় রয়ে গেছে। ফুটপাত ব্যবস্থাপনা এবং সিটি বাস সার্ভিস কার্যক্রমকে আমরা ঢেলে সাজানোর কোনো ব্যবস্থা না করেই সরাসরি শেষ দাওয়াই মেট্রোরেল কার্যক্রমে চলে গেছি। এটা উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন, অত্যাধুনিক, পাশাপাশি এটা ব্যয়বহুল একটি অবকাঠামো। আগের ধাপগুলো সঠিকভাবে কাজ না করলে শেষ ধাপ, অর্থাত্ মেট্রোরেল যানজট নিরসনে কতটা কার্যকর অবদান রাখতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাস্তবে এটা হয়তো ‘হাতি পালা’র মতো একটি বিষয়ে পরিণত হতে পারে। এটা এমন নয় যে, আমি মেট্রোরেল নির্মাণ করলাম, তারপর সব ভুলে গেলাম, সে নিজের মতো চলতে থাকবে। প্রতিদিন অত্যন্ত দরদ দিয়ে এটা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যেহেতু মেট্রোরেল নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিরাট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, সেহেতু আগের ধাপের পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে সঠিকভাবে নজর দেওয়া উচিত। একবিংশ শতাব্দীতে যোগাযোগব্যবস্থায় মেট্রোরেলকে পৃথক বা বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
মেট্রোরেল তৈরির সময় শুধু মেট্রোর দিকে তাকালে হবে না, বিষয়টি সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। মেট্রোরেলের সঙ্গে তার আন্তঃসংযোগ ও প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। যারা মেট্রোরেলের যাত্রী, তারা কীভাবে স্টেশনে আসবে, তা পরিকল্পনায় থাকতে হবে। তখনই ফুটপাতের প্রশ্নটি এসে যাবে। একই সঙ্গে মেট্রোরেল স্টেশনের সঙ্গে উন্নতমানের সংযোগ সড়ক থাকতে হবে। কারণ স্টেশনের সঙ্গে যদি সংযোগ সড়ক না থাকে, তাহলে যাত্রীরা সহজে মেট্রোরেল স্টেশনে যাতায়াত করতে পারবে না। মেট্রো স্টেশনের আশপাশে অন্তত ১ কিলোমিটার দূরত্বের যাত্রীরা যাতে সহজে হেঁটে স্টেশনে আসতে পারে, সে জন্য পথচারীবান্ধব নিরবচ্ছিন্ন ও প্রসারিত ফুটপাত থাকতে হবে। আবার যারা মেট্রোরেলের যাত্রী হবে না, তারা যাতে ফুটপাতে বাধাহীনভাবে চলাচল করতে পারে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমরা মেট্রোরেল-ব্যবস্থা তৈরি করলেও এখনো উন্নতমানের ফুটপাতের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারিনি। অন্যদিকে যারা স্টেশন থেকে এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বাইরে থাকে, তারা তো হেঁটে আসবে না। তাদের জন্য বাস বা অন্য কোনো সহজ এবং আরামদায়ক পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাত্, উন্নতমানের ফিডার সার্ভিস দিতে হবে। কিন্তু সেদিকে আমাদের মনোযোগ নেই। আমরা সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারিনি। সমস্যটা হচ্ছে, রাজধানী ঢাকা শহর অত্যন্ত জনবহুল এবং আমরা এই শহরকে যেহেতু পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে পারিনি, তাই আমরা চাইলেও এই অবস্থায় সিটি বাস দিয়ে উন্নতমানের কানেক্টিভিটি এখন আর তৈরি করতে পারব না। কারণ মূল সড়কের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী সড়কগুলো খুবই সংকীর্ণ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো সিটি বাস চলাচলের উপযোগী নয়। বিশেষত ঢাকা শহরে যে পরিমাণ সড়ক আছে, তার মাত্র আড়াই শতাংশে সিটি বাস সার্ভিস প্রবেশ ও চলাচল করতে পারে। তাই কানেক্টিভিটির জন্য সংযোগ সড়কে পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক প্যারাট্রানজিট চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ যদিও মেট্রোরেল একটি স্বস্তিদায়ক ও নির্ভরযোগ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনা, যারা মেট্রোরেলে যাতায়াত করবে, তারা শুধু এর আরামদায়ক ব্যবস্থাটিই দেখবে তা নয়। যাত্রীরা বাসা থেকে যাত্রা শুরুর স্টেশনে এবং যাত্রা শেষের স্টেশন থেকে গন্তব্যস্থলে চলাচলের জন্য আরামদায়কের চেয়েও সময় ও ব্যয়ের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেয়। মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যাওয়া গেলেও স্টেশনের যাওয়া-আসার খরচটি নিয়েও তাকে ভাবতে হয়। কিন্তু যে মেট্রোরেল লাইন চালু করা হয়েছে, সেখানে আন্তঃসংযোগ ও প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে মারাত্মক দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতার কারণে যানজট নিরসনের যে উদ্দেশ্য নিয়ে মেট্রোরেল তৈরি করা হয়েছে, তা কতটা সাধিত হবে, সে বিষয়ে কিছুটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে। বিশেষত মেট্রোরেলের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল নিচের সড়ক থেকে ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীদের মেট্রোরেলে আকৃষ্ট করা। কারণ, যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে, তারা সড়কের ৬০ শতাংশ স্থান জুড়ে থাকে। কিন্তু যাত্রী বহন করে মাত্র ৬ শতাংশের মতো। যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে, তাদের যদি আমরা মেট্রোতে নিতে পারি, তাহলে নিচের সড়ক অনেকটা আপনাআপনিই যানজটমুক্ত হবে। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যদি কেউ স্টেশনে এসে মেট্রোরেলে উঠতে চায়, তাহলে তাদের জন্য স্টেশনের আশপাশে অবশ্যই পার্কিং প্লেস তৈরি করতে হবে। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারিনি। বাস্তবে ব্যক্তিগত গাড়ি কমানো গেলে নিচের সড়কে যে সিটি বাস সার্ভিস আছে, তাদের জন্য একটি প্রসারিত সড়ক দেওয়া সম্ভব হতো। আমরা আমাদের পরিকল্পনা থেকে দূরে সরে গেছি। কারণ নিচের বাস সার্ভিসের যারা যাত্রী ছিল, তাদের অনেকেই এখন মেট্রোরেলের যাত্রী হয়ে গেছে। ফলে মেট্রোরেলের উপযোগিতা আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি।
মেগা প্রকল্পের জন্য সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রয়োজন। পরিকল্পনায় যদি ভুল থাকে, তাহলে তা কখনোই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সুফল দিতে পারে না। নতুন নতুন সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সেই সমস্যা সমাধানের জন্য আরো বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। আমার যদি আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য কিছুটা হলেও আমরা বেশি খরচ করে ফেলেছি। যেখানে ভারতে উড়াল মেট্রো রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রতি কিলোমিটারে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়, সেখানে মেট্রোরেল নির্মাণে আমরা প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছি। এমনকি দুবাই মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। নিঃসন্দেহে আমাদের পাতাল রেললাইন করতে গেলে খরচের পরিমাণ আরো কয়েক গুণ বাড়বে। সংগত কারণে আমরা যদি বিনিয়োগের ব্রেক ইভেন পয়েন্টে পৌঁছাতে চাই, তাহলে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। তাই মেট্রোরেলভিত্তিক প্রচুর গবেষণা হওয়া উচিত, কীভাবে মেট্রো নির্মাণে খরচের দিক থেকে সাশ্রয়ী হওয়া যায়। পাশাপাশি মেট্রো পরিচালনার ব্রেক ইভেন পয়েন্টে পৌঁছাতে হলে ভাড়ার পাশাপাশি ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক আয়ের খাত তৈরি করতে হবে। ঢাকা শহরে মেট্রোরেলের ভাড়া আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই বেশি। যদি বাণিজ্যিক আয়গুলো ভাড়ার স্ট্রাকচারে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা মেট্রোরেল-ব্যবস্থাকে গণবান্ধব ও যাত্রীসহায়ক করা সম্ভব হবে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
Tags
daily news