প্রাচীন ভারতের মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্তের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সহচর চাণক্যের অপর নাম কৌটিল্য। আর এই কৌটিল্য নীতিকে মেনেই জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কূটনীতির দারুণ খেলাটি পারদর্শিতার সঙ্গে খেললেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

জি-২০ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে ‘নয়াদিল্লি ঘোষণাপত্র’ গৃহীত হওয়ার ঘোষণা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত
এ যেন এক অন্য দিল্লি। রং-বেরংয়ের পোস্টারে ছেয়ে গেছে সারা শহর। বিদ্যালয়ের বাচ্চারা রং-তুলি দিয়ে আঁকছেন বিশ্বনেতাদের ছবি, আর সড়কে-দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সম্মেলনকেন্দ্রিক নানা চিত্রকর্ম। আগে যেখানে জি-২০ সম্মেলন হলে পুঁজিবাদের বিপক্ষে বিক্ষোভ-ভাঙচুর ছিল নিত্যকার ঘটনা, যেখানে কোনো রকমে একটি সম্মেলন হয়ে গেলেই হলো, সেখানে এমন সাজসজ্জা এবং উৎসবমুখর পরিবেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে।
শুধু রং-রূপ দিয়ে নয়, কূটনীতির চাল দিয়েও পুরো সম্মেলনকে চাঙ্গা রেখেছে মোদি সরকার। ভারতের প্রাচীন কূটনীতিবিদ কৌটিল্য নীতিশাস্ত্রে বলেছেন, বিষ থেকে সুধা, আর নিচ থেকে সোনা আহরণেই পারদর্শিতার প্রমাণ। একদিকে বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রতিযোগী দেশ, অন্যদিকে দাওয়াত করে আনা স্বল্পোন্নত দেশের সমারোহে আয়োজিত এবারের জি-২০ সম্মেলনই প্রমাণ করে প্রাচীন কূটনীতিকে আধুনিক রূপে রাঙিয়েছেন মোদি।
ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০২২ সালের নভেম্বরে জি-২০-এর সভাপতিত্ব পায় ভারত। আর তারপর থেকেই পুরো এক বছর ধরে নিজেদের কূটনীতির চাল ঠিকভাবে চালার জন্য পরিকল্পনা করে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিধর এ দেশটি। এবার খাতাকলমে জি-২০ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নকে সুদৃঢ় করা। কিন্তু খাতাকলমে যাই থাক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য স্পষ্ট এবং সুদূরপ্রসারী। তিনি এ সম্মেলনকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব দরবারে ভারতের কূটনৈতিক সক্ষমতাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন; আর আগামী বছরের নির্বাচনে নিজ দেশে নিজের এবং দলের গ্রহণযোগ্যতাকেও নিয়ে গেলেন তুঙ্গে।
জি-২০ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভাকে আগামী বছর জি-২০ সম্মেলনের সভাপতিত্বের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত
এবারের জি-২০ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য 'ভাসুধাইভা কুতুমবাকাম'। সংস্কৃত এ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘সারা বিশ্ব একটি পরিবার’। আর এ পরিবারের কর্তা হবার বাসনাই যে পোষণ করছে ভারত, তা এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। কদিন আগেও যখন ব্রিকস আর জি-৭ নিয়ে হচ্ছিল নানা তর্ক-বিতর্ক, প্রশ্ন উঠেছিল কে কাকে ছাপিয়ে যাবে, সেখানে এই দুই সংঘের বাঘা বাঘা সদস্যরা জি-২০ কে কেন্দ্র করে অবস্থান করছেন এক ছাদের নিচে। আগেকার সময়ে জি-২০ ছিল শক্তিধর অর্থনৈতিক দেশগুলোর মিলনমেলা, সেখানে এবার আফ্রিকান ইউনিয়নকে সম্পৃক্ত করে এবং বাংলাদেশ থেকে শুরু করে অনেক স্বল্পোন্নত দেশকে আমন্ত্রণের মাধ্যমে ভারত প্রমাণ করেছে, এবারের জি-২০ সম্মেলন আগে থেকে অনেক বেশি সর্বজনীন।
যেখানে আফ্রিকা বা স্বল্পোন্নত দেশ মানেই চীনা ঋণের ফাঁদ, সেখানে জি-২০ সম্মেলনে এবারের মূল আলোচনার একটি প্রধান বিষয় ছিল, ঋণ সহজীকরণ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব মোড়ল এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণনীতি যত কঠিন করবে, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলো তত বেশি বিপদে পড়বে। বিশেষ করে আফ্রিকার দেশ ঘানা, জাম্বিয়া, ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার কথা উঠে আসে সম্মেলনে যোগ দেয়া নেতাদের আলোচনা থেকে।
সংবাদমাধ্যম ইকনোমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের কূটনীতির লক্ষ্য ছিল গরিব দেশগুলোর শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হওয়া। আর সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ভারত যে গরিব এবং স্বল্পোন্নত দেশের মুর্শিদ হতে চলছে, সেটি এবারের জি-২০ সম্মেলনের কার্যাকলাপ থেকে স্পষ্ট। একদিকে গরিব দেশের কণ্ঠস্বর, অন্যদিকে শক্তিমান দেশের সঙ্গে সমানতালে টেক্কা দিয়ে চলার ক্ষমতাকে ভারতের বিস্ময়কর সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
বর্তমান বিশ্বে ভারতের একমাত্র প্রকাশ্য শত্রু চীন। আর এবারের জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেননি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অন্যদিকে বিশ্ব এখন পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঝাঁঝ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছিল, এবারের সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যোগ দিলে এ নিয়ে আরেক দফা আলোচনা হবে। কিন্তু পুতিনও যোগ দেননি সম্মেলনে। মূলত এ দুই বিশ্বনেতার সম্মেলনে যোগ না দেয়া বিশ্ব মেরুকরণে নতুন বার্তা দিচ্ছে।
জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সায়মা ওয়াজেদ। ছবি: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
বিশ্লেষকদের মতামত, ভারত রাশিয়া থেকে সস্তায় জ্বালানি তেল কিনছে ঠিকই, কিন্তু হাঁটেনি সস্তা কূটনীতির পথে। বাইডেনের সঙ্গে মোদির দহরম-মহরমই প্রমাণ করে নিজের অবস্থান বজায় রেখে চলছে ভারত। অনেকটা মৌর্য যুগের রাজা চন্দ্রগুপ্ত যেমনি আলেকজান্ডারের সেনাপতির মেয়ে হেলেনাকে বিয়ে করে পশ্চিমকে হাতে রেখেছিল, অন্যদিকে রাজপুত ঘরানার মেয়ে বিয়ে করে দক্ষিণের বাণিজ্যে নিজের অবস্থান অটুট রেখেছিলেন; ঠিক সেভাবেই পুতিনের সঙ্গে বাণিজ্য এবং বাইডেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন মোদি।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ ভারতীয় বিশ্বাস করে মোদির নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে ভারত পৌঁছে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায়। যেখানে ঘনিয়ে আসছে ভারতের জাতীয় নির্বাচন, যেখানে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী নিজেকে পোক্ত প্রমাণ করতে হেন কিছু নেই করছেন না, সেখানে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অনুসারী না, এমন ৬০ শতাংশ মানুষও মোদি সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করেন। এতে করে বোঝা যাচ্ছে, এই এক সম্মেলন কাজে লাগিয়ে মোদি সরকার ‘ভিতর-বাহির’ সবদিকেই নিজের অবস্থান অটুট রাখছে।
বিশেষ করে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে মহাত্মা গান্ধীর আশ্রম রাজঘাটের বাপু কুটিতে বিশ্বনেতাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন ভারতের জনগণকে দেখিয়ে দিল, বাপু কারও একার না বা কংগ্রেসের নিজস্ব সম্পত্তি না। বৃষ্টিস্নাত দিনে বাপু কুটির সামনে অঙ্গবস্ত্রম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোদি মূলত ভারতের মানুষের কাছে অভিন্ন ভারত বার্তাটিই পৌঁছে দিয়েছেন আর নিজ দেশে নিজের অবস্থানকে করেছেন আরও শক্তিশালী।
জি-২০ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে ভারতের অরুণাচল নিয়ে চীনের মানচিত্র প্রকাশের প্রতিশোধ, অন্যদিকে বহুদিনের চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে জল ঢেলে দেয়ার মতো কাজ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপকে সংযুক্ত করে ভারতের সঙ্গে নতুন একটি বহুজাতিক রেল এবং শিপিং করিডোরের প্রকল্প উন্মোচন। চলতি বছরেই যখন ইরানের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক উন্নয়নে চীন ছিল মধ্যমণি, সেখানে এবারের সম্মেলনে সৌদি যুবরাজ সালমান, ভারতের মোদি ও বাইডেনের মিলিত হাতের ছবিই বলে দিচ্ছে, চীনের কূটনৈতিক চালকে সবদিক দিয়ে টেক্কা দিচ্ছে ভারত।
বার্তাসংস্থা আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এই করিডোর মূলত ভারতের গেইম চেইঞ্জিং পরিকল্পনা। যেখানে এমনিতেই চীনের বাণিজ্য এবং প্রবৃদ্ধিতে চলছে মন্দাভাব, দেশটির ঋণনীতি নিয়ে অতিষ্ঠ অন্যরা, সেখানে এমন উদ্যোগ চীনকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলবে। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভারত এই করিডোরের মাধ্যমে আগের থেকে আরও ৪০ শতাংশ কম সময় ব্যয় করে ইউরোপের বাজারে নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে পারবে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে।
দিল্লির ভারত মণ্ডপমে আয়োজিত মূল সম্মেলনে এবার মোদির সামনে যে নেইম প্লেট ছিল সেখানে ইন্ডিয়ার বদলে প্রথমবারের মতো লেখা ছিল ভারত। সম্মেলনের মিডিয়া সেন্টারে 'ভারত দ্য মাদার অব ডেমোক্রেসি' ম্যাগাজিনের মূল সারমর্ম ছিল, বিশ্বে গণতন্ত্রের সূতিকাগার এই ভারত। ৬ হাজার খ্রীষ্টপূর্ব থেকে এই মুল্লুকে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে বলে ম্যাগাজিনটিতে বলা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে গণতন্ত্র মানেই মার্কিনিদের জয়জয়কার, সেখানে বিশ্বনেতাদের সামনে ইন্ডিয়া থেকে নাম বদলে ভারত করে মোদি হয়তো ভবিষ্যতে ভারতের অবস্থান নিয়ে নতুন এক বার্তা দিলেন। মোদির বক্তব্যের সময় যখন প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ার বদলে প্রেসিডেন্ট অব ভারত বলা হলো, হয়তো এইটুকুর মধ্য দিয়েই মোদি নতুন নামকরণের পাশাপাশি নিজেকে নতুন ভারতের ত্রাণকর্তা এবং বিশ্বনেতাদের মুর্শিদ হবার মনোবাসনারই ইঙ্গিত দিয়েছেন এই সম্মেলনের মাধ্যমে।

জি-২০ সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে ‘নয়াদিল্লি ঘোষণাপত্র’ গৃহীত হওয়ার ঘোষণা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত
এ যেন এক অন্য দিল্লি। রং-বেরংয়ের পোস্টারে ছেয়ে গেছে সারা শহর। বিদ্যালয়ের বাচ্চারা রং-তুলি দিয়ে আঁকছেন বিশ্বনেতাদের ছবি, আর সড়কে-দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সম্মেলনকেন্দ্রিক নানা চিত্রকর্ম। আগে যেখানে জি-২০ সম্মেলন হলে পুঁজিবাদের বিপক্ষে বিক্ষোভ-ভাঙচুর ছিল নিত্যকার ঘটনা, যেখানে কোনো রকমে একটি সম্মেলন হয়ে গেলেই হলো, সেখানে এমন সাজসজ্জা এবং উৎসবমুখর পরিবেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে।
শুধু রং-রূপ দিয়ে নয়, কূটনীতির চাল দিয়েও পুরো সম্মেলনকে চাঙ্গা রেখেছে মোদি সরকার। ভারতের প্রাচীন কূটনীতিবিদ কৌটিল্য নীতিশাস্ত্রে বলেছেন, বিষ থেকে সুধা, আর নিচ থেকে সোনা আহরণেই পারদর্শিতার প্রমাণ। একদিকে বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রতিযোগী দেশ, অন্যদিকে দাওয়াত করে আনা স্বল্পোন্নত দেশের সমারোহে আয়োজিত এবারের জি-২০ সম্মেলনই প্রমাণ করে প্রাচীন কূটনীতিকে আধুনিক রূপে রাঙিয়েছেন মোদি।
ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০২২ সালের নভেম্বরে জি-২০-এর সভাপতিত্ব পায় ভারত। আর তারপর থেকেই পুরো এক বছর ধরে নিজেদের কূটনীতির চাল ঠিকভাবে চালার জন্য পরিকল্পনা করে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিধর এ দেশটি। এবার খাতাকলমে জি-২০ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নকে সুদৃঢ় করা। কিন্তু খাতাকলমে যাই থাক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য স্পষ্ট এবং সুদূরপ্রসারী। তিনি এ সম্মেলনকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব দরবারে ভারতের কূটনৈতিক সক্ষমতাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন; আর আগামী বছরের নির্বাচনে নিজ দেশে নিজের এবং দলের গ্রহণযোগ্যতাকেও নিয়ে গেলেন তুঙ্গে।

এবারের জি-২০ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য 'ভাসুধাইভা কুতুমবাকাম'। সংস্কৃত এ শব্দগুচ্ছের অর্থ ‘সারা বিশ্ব একটি পরিবার’। আর এ পরিবারের কর্তা হবার বাসনাই যে পোষণ করছে ভারত, তা এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। কদিন আগেও যখন ব্রিকস আর জি-৭ নিয়ে হচ্ছিল নানা তর্ক-বিতর্ক, প্রশ্ন উঠেছিল কে কাকে ছাপিয়ে যাবে, সেখানে এই দুই সংঘের বাঘা বাঘা সদস্যরা জি-২০ কে কেন্দ্র করে অবস্থান করছেন এক ছাদের নিচে। আগেকার সময়ে জি-২০ ছিল শক্তিধর অর্থনৈতিক দেশগুলোর মিলনমেলা, সেখানে এবার আফ্রিকান ইউনিয়নকে সম্পৃক্ত করে এবং বাংলাদেশ থেকে শুরু করে অনেক স্বল্পোন্নত দেশকে আমন্ত্রণের মাধ্যমে ভারত প্রমাণ করেছে, এবারের জি-২০ সম্মেলন আগে থেকে অনেক বেশি সর্বজনীন।
যেখানে আফ্রিকা বা স্বল্পোন্নত দেশ মানেই চীনা ঋণের ফাঁদ, সেখানে জি-২০ সম্মেলনে এবারের মূল আলোচনার একটি প্রধান বিষয় ছিল, ঋণ সহজীকরণ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব মোড়ল এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণনীতি যত কঠিন করবে, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলো তত বেশি বিপদে পড়বে। বিশেষ করে আফ্রিকার দেশ ঘানা, জাম্বিয়া, ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার কথা উঠে আসে সম্মেলনে যোগ দেয়া নেতাদের আলোচনা থেকে।
সংবাদমাধ্যম ইকনোমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের কূটনীতির লক্ষ্য ছিল গরিব দেশগুলোর শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হওয়া। আর সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ভারত যে গরিব এবং স্বল্পোন্নত দেশের মুর্শিদ হতে চলছে, সেটি এবারের জি-২০ সম্মেলনের কার্যাকলাপ থেকে স্পষ্ট। একদিকে গরিব দেশের কণ্ঠস্বর, অন্যদিকে শক্তিমান দেশের সঙ্গে সমানতালে টেক্কা দিয়ে চলার ক্ষমতাকে ভারতের বিস্ময়কর সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
বর্তমান বিশ্বে ভারতের একমাত্র প্রকাশ্য শত্রু চীন। আর এবারের জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেননি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অন্যদিকে বিশ্ব এখন পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ঝাঁঝ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছিল, এবারের সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যোগ দিলে এ নিয়ে আরেক দফা আলোচনা হবে। কিন্তু পুতিনও যোগ দেননি সম্মেলনে। মূলত এ দুই বিশ্বনেতার সম্মেলনে যোগ না দেয়া বিশ্ব মেরুকরণে নতুন বার্তা দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতামত, ভারত রাশিয়া থেকে সস্তায় জ্বালানি তেল কিনছে ঠিকই, কিন্তু হাঁটেনি সস্তা কূটনীতির পথে। বাইডেনের সঙ্গে মোদির দহরম-মহরমই প্রমাণ করে নিজের অবস্থান বজায় রেখে চলছে ভারত। অনেকটা মৌর্য যুগের রাজা চন্দ্রগুপ্ত যেমনি আলেকজান্ডারের সেনাপতির মেয়ে হেলেনাকে বিয়ে করে পশ্চিমকে হাতে রেখেছিল, অন্যদিকে রাজপুত ঘরানার মেয়ে বিয়ে করে দক্ষিণের বাণিজ্যে নিজের অবস্থান অটুট রেখেছিলেন; ঠিক সেভাবেই পুতিনের সঙ্গে বাণিজ্য এবং বাইডেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন মোদি।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ ভারতীয় বিশ্বাস করে মোদির নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে ভারত পৌঁছে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায়। যেখানে ঘনিয়ে আসছে ভারতের জাতীয় নির্বাচন, যেখানে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী নিজেকে পোক্ত প্রমাণ করতে হেন কিছু নেই করছেন না, সেখানে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অনুসারী না, এমন ৬০ শতাংশ মানুষও মোদি সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করেন। এতে করে বোঝা যাচ্ছে, এই এক সম্মেলন কাজে লাগিয়ে মোদি সরকার ‘ভিতর-বাহির’ সবদিকেই নিজের অবস্থান অটুট রাখছে।
বিশেষ করে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে মহাত্মা গান্ধীর আশ্রম রাজঘাটের বাপু কুটিতে বিশ্বনেতাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন ভারতের জনগণকে দেখিয়ে দিল, বাপু কারও একার না বা কংগ্রেসের নিজস্ব সম্পত্তি না। বৃষ্টিস্নাত দিনে বাপু কুটির সামনে অঙ্গবস্ত্রম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোদি মূলত ভারতের মানুষের কাছে অভিন্ন ভারত বার্তাটিই পৌঁছে দিয়েছেন আর নিজ দেশে নিজের অবস্থানকে করেছেন আরও শক্তিশালী।
জি-২০ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে ভারতের অরুণাচল নিয়ে চীনের মানচিত্র প্রকাশের প্রতিশোধ, অন্যদিকে বহুদিনের চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে জল ঢেলে দেয়ার মতো কাজ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপকে সংযুক্ত করে ভারতের সঙ্গে নতুন একটি বহুজাতিক রেল এবং শিপিং করিডোরের প্রকল্প উন্মোচন। চলতি বছরেই যখন ইরানের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক উন্নয়নে চীন ছিল মধ্যমণি, সেখানে এবারের সম্মেলনে সৌদি যুবরাজ সালমান, ভারতের মোদি ও বাইডেনের মিলিত হাতের ছবিই বলে দিচ্ছে, চীনের কূটনৈতিক চালকে সবদিক দিয়ে টেক্কা দিচ্ছে ভারত।
বার্তাসংস্থা আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এই করিডোর মূলত ভারতের গেইম চেইঞ্জিং পরিকল্পনা। যেখানে এমনিতেই চীনের বাণিজ্য এবং প্রবৃদ্ধিতে চলছে মন্দাভাব, দেশটির ঋণনীতি নিয়ে অতিষ্ঠ অন্যরা, সেখানে এমন উদ্যোগ চীনকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলবে। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ ভারত এই করিডোরের মাধ্যমে আগের থেকে আরও ৪০ শতাংশ কম সময় ব্যয় করে ইউরোপের বাজারে নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে পারবে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে।
দিল্লির ভারত মণ্ডপমে আয়োজিত মূল সম্মেলনে এবার মোদির সামনে যে নেইম প্লেট ছিল সেখানে ইন্ডিয়ার বদলে প্রথমবারের মতো লেখা ছিল ভারত। সম্মেলনের মিডিয়া সেন্টারে 'ভারত দ্য মাদার অব ডেমোক্রেসি' ম্যাগাজিনের মূল সারমর্ম ছিল, বিশ্বে গণতন্ত্রের সূতিকাগার এই ভারত। ৬ হাজার খ্রীষ্টপূর্ব থেকে এই মুল্লুকে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে বলে ম্যাগাজিনটিতে বলা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে গণতন্ত্র মানেই মার্কিনিদের জয়জয়কার, সেখানে বিশ্বনেতাদের সামনে ইন্ডিয়া থেকে নাম বদলে ভারত করে মোদি হয়তো ভবিষ্যতে ভারতের অবস্থান নিয়ে নতুন এক বার্তা দিলেন। মোদির বক্তব্যের সময় যখন প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ার বদলে প্রেসিডেন্ট অব ভারত বলা হলো, হয়তো এইটুকুর মধ্য দিয়েই মোদি নতুন নামকরণের পাশাপাশি নিজেকে নতুন ভারতের ত্রাণকর্তা এবং বিশ্বনেতাদের মুর্শিদ হবার মনোবাসনারই ইঙ্গিত দিয়েছেন এই সম্মেলনের মাধ্যমে।
সূত্র: সময়
Tags
world news