আপনারে খুজিয়া বেড়াই

 আমার মা ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। শ্যামলা ধরনের একহারা গড়নের মেয়ে। নানার অতি আদরের মেয়ে। কেমন করে জানি সবার ধারনা হল, এই মেয়ে তেমন বুদ্ধিমতী হয়নি। তাঁকে বুদ্ধিমতী বানানোর জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল বারহাট্টায়। বারহাট্টায় আমার মা'র মামাবাড়ি। মা'র নানীজান অসম্ভব বুদ্ধিমতী। তিনি যদি ট্রেনিং দিয়ে এই মেয়েকে কিছুটা মানুষ করতে পারেন।

তাঁর ট্রেনিং এ তেমন কাজ হল না। মা'র বুদ্ধি বিশেষ বাড়ল না। তবে ক্লাস টুতে তখন সরকারী পর্যায়ে একটি বৃত্তি পরীক্ষা হত। মা এই পরীক্ষা দিয়ে মাসে দু'টাকা হারে বৃত্তি পেয়ে চারদিকে চমক সৃষ্টি করে ফেললেন। "এ কি কান্ড! মেয়ে মানুষ সরকারী জলপানি কি করে পায়?" মা'র দূর্ভাগ্য, বৃত্তির টাকা তিনি পাননি। কারণ, তাঁকে উপরের কোন ক্লাসে ভর্তি করান হল না। মেয়েদের পরাশুনার দরকার কি! চিঠি লিখার বিদ্যা থাকলেই যথেষ্ট। না থাকলেও ক্ষতি নাই। মেয়ে মানুষ এত চিঠি লেখালেখিরই বা কি প্রয়োজন?? তারা ঘর-সংসার করবে। নামাজ-কালাম পরবে। এর জন্য বাংলা-ইংরেজী শেখার দরকার নাই। তারচে' বরং হাতের কাজ শিখুক রান্না বান্না শিখুক, আঁচার বানানো, পিঠা বানানো শিখুক। বিয়ের সময় কাজে লাগবে।
.
আমার মা পড়াশুনা বাদ দিয়ে এইসব কাজ অতি যত্নের সঙ্গে শিখতে লাগলেন। এই করতে করতে একদিন তাঁর বয়স হয়ে গেল পনেরো। কী সর্বনাশের কথা! পনেরো হয়ে গেছে, এখনো বিয়ে হয়নি! বারহাট্টা থেকে কঠিন সব চিঠি আসতে লাগল। যেন অবিলম্বে বিয়ের চেষ্টা করা হয়। চারদিকে সুপাত্র খোঁজা চলতে লাগল। একজন সুপাত্রের সন্ধান আনলেন মা'র দূর সম্পর্কের চাচা, শ্যামপুরের দুদু মিয়া। দুদু মিয়াও পাগল ধরনে মানুষ। বি. এ. পাশ করেছেন। দেশ নিয়ে মাথা ঘামান। কি করে অশিক্ষিত মূর্খ মুসলমানদের রাতারাতি শিক্ষিত করা যায়। নানাজান তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, "ছেলে কী করে?"
-"কিছু করে না। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসে সারাদিন বই পড়ে। দীর্ঘদিন তার সাথে কলকাতায় এক মেসে ছিলাম। বাড়ির অবস্থা শোচনীয়, আত্মীয়-স্বজন হত দরিদ্র। তবে ছেলের বাবা উলা পাশ। বড় মৌলানা—অতি সজ্জন ব্যক্তি।"
-"অতি সজ্জন ব্যক্তি দিয়ে কাজ হবে না। রাতদিন যেই ছেলে বই পড়ে সে ঘর-সংসার চালাবে কি করে?"
ছেলে দেখতে রাজপুত্রের মত শুধু এ কারণেই নানাজান ছেলের বাবার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন। কথা বলে মুগ্ধও হলেন।
আমার দাদা মৌলানা আজিমুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরবি-ফারসিতে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। অতি বিনয়ী মানুষ ছিলেন। ছেলের বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে নানাজান একজন বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দেবার প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন। নানাজান কী মনে করে চলে গেলেন, মৈমনসিংহ। ছেলে নাটক-নভেল পড়ে, মেয়েকেও তার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। নানাজান একটা নভেল কিনে এনে, সেই নভেল মা'র হাতে তুলে দিলেন। মা জীবনে এটাই প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসের নাম—"নৌকাডুবি"। লেখক- শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম উপন্যাস পড়েই "মা" মোহিত। একবার, দু'বার, তিনবার পড়া হল, তবু যেন ভাললাগা শেষ হয় না। বাসররাতে বাবা মাকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি কখনো বই-টই পড়েছ? এই ধর, গল্প-উপন্যাস?" মা লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
-"দুই-একটা বইয়ের নাম বলতে পারবে?"
মা ক্ষীণ স্বরে বললেন, "নৌকাডুবি।"
গভীর বিস্ময়ে বাবা দীর্ঘসময় কথা বলতে পারলেন না। এই অজ পাড়াগাঁয়ের একটি মেয়ে কি-না রবীন্দ্রনাথের 'নৌকাডুবি' পড়ে ফেলেছে?
গ্রামের যে বোকা ধরনের মেয়ে বিয়ের পর শহরে চলে এল, আমার ধারণা, সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী মেয়েদেরেই একজন। আমি এখনও তাঁর বুদ্ধির ঝলকে চমকে চমকে উঠি। মা শুধু যে বুদ্ধিমতী তাই না, অসম্ভব সাহসী ও স্বাধীন ধরনের মহিলা। ১৬ই ডিসেম্বরের পর আমার মা আমাদের ভাইবোন সবাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। হাতে একটি পয়সাও নাই। এই অবস্থায় পুরনো পল্টনে বাড়ি ভাড়া করলেন। আমাদের সবাইকে একত্রে করে বললেন, "তোরা তোদের পড়াশোনা চালিয়ে যা। সংসার নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না। আমি দেখব।" ঐ বাড়িতে আমাদের কোন আসবাবপত্র ছিল না। আমরা মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে ঘুমাতাম। কেউ বেড়াতে এলে তাকে মেঝেতে বসতে হত। মা নানান সমিতিতে ঘুরেঘুরে সেলাইয়ের কাজ যোগাড় করলেন। দিনরাত মেশিন চালান। জামা-কাপড় তৈরি করেন। সেলাইয়ের রোজগারের সঙ্গে বাবার পেনশনের নগন্য টাকা যুক্ত হয়ে সংসার চলত। তিনি শুধু যে ঢাকার সংসার চালাতেন তাই না, মোহনগঞ্জে তাঁর বাবার বাড়ির সংসারও এখান থেকেই দেখাশোনা করতেন।
অনেক কাল আগে গ্রামের এই বোকা-বোকা ধরনের লাজুক কিশোরী মেয়েটি কখনো কল্পনাও করেতে পারেনি কি কঠিন সংগ্রাময় জীবন অপেক্ষা করছে তার জন্য। যুদ্ধ ক্লান্ত এই বৃদ্ধা মহিলা এখন কী ভাবেন আমি জানিনা। তাঁর পুত্র-কন্যারা নানান ভাবে তাকে খুশি করতে চেষ্টা করেন। তিনি তাদের সে সুযোগ দিতে চান না। আমার ছোট ভাই ডঃ জাফর ইকবাল আমেরিকা থেকে টিকেট পাঠিয়ে দিয়ে লিখল—
মা, আপনি আসুন, আপনাকে আমেরিকা এবং ইউরোপ ঘুরিয়ে দেখাব। আপনার ভাল লাগবে। মা বললেন, "যে জিনিস তোমার বাবা দেখে যেতে পারেন নি, আমি তা দেখব না।" আমি বললাম, "আম্মা, আপনি কি হজ্বে যেতে চান? ব্যবস্থা করি।"
-"না।"
-"ছোটবেলায় দেখেছি আপনি জরি দিয়ে—তাজমহল ছবি এঁকেছিলেন। তাজমহল দেখতে ইচ্ছে করে?"
-"না। আমি একা একা কিছু দেখব না।"
বাবার মৃত্যুর পর বাবার পছন্দের জিনিস কখনো বাসায় রান্না হয় নি। সেই সব খাবার হচ্ছে বুটের ডাল দিয়ে গরুর গোশত। আর একটি বরবটির চচ্চড়ি। আহামরি কোন খাবার নয়। (* আমার ছেলেবেলা গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর কী মনে করে জানি মা আমেরিকা যেতে রাজি হলেন। ছ'মাস সেখানে কাটিয়েও এসেছেন। তার কিছুদিন পর আমাকে বললেন, "হজ্ব করতে চান।")
.
আমি একবার বললাম, "আমাদের জন্য আপনার কি কোন উপদেশ আছে?"
তিনি খানিকক্ষন চুপ থেকে বললেন,উপদেশ নয়, "একটি আদেশ আছে। আদেশটি হচ্ছে—কেউ যদি কখনো তোমাদের কাছে টাকা ধার চায়, তোমরা 'না' করবে না। আমাকে অসংখ্যবার মানুষের কাছে ধারের জন্য হাত পাততে হয়েছে। ধার চাওয়ার লজ্জা এবং অপমান আমি জানি।"
(অপ্রসঙ্গিকভাবে বলি) মা'র অসাধারন ইএসপি বা অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা ছিল। প্রায় সময় ভবিষ্যতে কি ঘটনা ঘটবে তা হুবুহু বলতে পারতেন। মা'র এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পর্কে বাবা পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন। মা'কে তিনি ঠাট্টা করে ডাকতেন, 'মহিলা পীর'। মা'র এই ক্ষমতা বাবার মৃত্যুর পরপরই পুরপুরি নষ্ট হয়ে যায়।
- হুমায়ূন আহমেদ (আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই)

ছবিঃ সংগৃহীত



Previous Post Next Post

نموذج الاتصال