আপনার সঙ্গে আর দেখা হয় না, হুমায়ূন ভাই

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেক লেখা লিখেছি। টুকরো টুকরো সেই সব লেখা নিয়ে একটা বই বেরিয়েছে। নাম 'প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ'। প্রকাশক অন্যপ্রকাশ। কিছু স্মৃতিচারণা, কিছু সাক্ষাৎকার এই সব মিলিয়ে সেই বই।
যারা হুমায়ূন ভাই এবং আমার সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন অসাধারণ সম্পর্ক ছিল আমাদের দুজনার। হুমায়ূন আহমেদ খুবই স্নেহ করতেন আমাকে, ভালোবাসতেন। বহু দিনের বহু মধুর স্মৃতি তার সঙ্গে। আমরা নেপালে বেড়াতে গেছি, আগরতলায় গেছি, আমেরিকায় গেছি। পোখারায় গিয়ে ভোরবেলা অন্নপূর্ণা রেঞ্জ দেখতে গেছি, আগরতলায় গিয়ে দেখেছি 'নীরমহল', আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই সব মধুময় দিনের কথা নানা রকমভাবে লিখেছি। আমি তো লিখেছিই, হুমায়ূন ভাইও লিখেছেন।
আর ছিল আমাদের প্রায় প্রতিদিনকার আড্ডা। কখনো ধানমন্ডির দখিন হাওয়ায়, কখনো নুহাশ পল্লীতে। কী প্রাণবন্ত আড্ডা। হুমায়ূন ভাই একাই মাতিয়ে রাখতেন পুরো আড্ডা। হাসিঠাট্টা, মজার মজার আচরণে হুমায়ূন ভাইয়ের তুলনা হুমায়ূন ভাই নিজে। তার জীবনযাপন পদ্ধতিটাই ছিল অন্যরকম। সম্রাটের মতো জীবনযাপন। দুই হাতে খরচা করতেন। ভোজনরসিক হিসেবে অতুলনীয়। ১২ হাজার টাকা দিয়ে হয়তো একটা কাতলা মাছ কিনে ফেললেন। তারপর বন্ধুদের নিয়ে সেই মাছের সঙ্গে আরও বহু পদ, খাওয়া-দাওয়া চলল। এ ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা।
লেখালেখি নিয়ে মেতে থাকা, নাটক লেখা এবং তৈরি করা, সিনেমা তৈরি, গান লেখা যখন যা করতেন, এমনভাবে ডুবে যেতেন সেই বিষয়ে, অন্য কোনো দিকে খেয়াল নেই। গভীর রাত পর্যন্ত বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিয়েছেন, কিন্তু ঠিকই সকালবেলা অন্যদের ঘুম ভাঙার আগে উঠে লিখতে বসে গেছেন। চেয়ার-টেবিলে বসে লিখতেন না হুমায়ূন ভাই। লিখতেন মেঝেতে বসে, জলচৌকির ওপর কাগজ রেখে। লুঙ্গি পরতেন ঘরে কিন্তু লুঙ্গির গিঁট প্রায় বুকের কাছে। এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভাসছে, খালি গায়ে দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে বসে লিখছেন হুমায়ূন ভাই। সামনে জলচৌকির ওপর কাগজ, হাতের কাছে চায়ের কাপ, এক হাতে সিগ্রেট, এক হাতে কলম। কোনো দিকে খেয়াল নেই, লিখে যাচ্ছেন। চায়ে হয়তো চুমুক দিয়েছেন, আবার লেখার তালে এসট্রেতে ছাই না ফেলে হয়তো চুমুক দেওয়া চায়ের কাপেই ফেলে দিলেন সিগ্রেটের ছাই, সেই চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে চমকালেন।
কখনো কখনো হঠাৎ সকালবেলা দখিন হাওয়ায় চলে গেছি। কোনো কারণ নেই। কয়েক দিন দেখা হয়নি, রাস্তায় বেরিয়ে মনে হয়েছে, হুমায়ূন ভাইকে একটু দেখে আসি।
লেখার সময় কেউ এলে বিরক্ত হতেন। আমার ওপর কখনো বিরক্ত হয়েছেন এমন স্মৃতি নেই। দেখেই সিগ্রেটে টান দিয়ে বলতেন, আসো মিলন। এখনো কোনো কোনো সকালে রাস্তায় বেরিয়ে মনে হয় যাই দখিন হাওয়ায়। হুমায়ূন ভাইকে একটু দেখে আসি। বুকটা হু হু করে।
এক সন্ধ্যায় নুহাশ পল্লীতে গেছি। রাতভর আড্ডা হলো। আমার ঘুম ভেঙেছে খুব সকালে। তখনও চারদিক ঠিকমতো ফর্সা হয়নি। বাইরে পাখি ডাকছে, হাওয়া বইছে গাছপালায়। নুহাশ পল্লীর সবুজ ঘাস একটু বুঝি শিশির ভেজা। সবাই ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম একা একা মাঠে ঘুরি, পুকুরের ওদিকটায় যাই। একাকী নির্জন সবুজ সকালবেলাটা দেখি। ঘর থেকে বেরিয়েছি। বেরিয়ে অবাক। সবুজ ঘাসের মাঠে পেছনে দুই হাত, লুঙ্গি আর দলামোচড়া করা সাদা পাঞ্জাবি পরে হুমায়ূন ভাই হাঁটছেন। ধীর পা। গভীর চিন্তামগ্ন একজন মানুষ। আমি দূর থেকে অনেকক্ষণ তাকে দেখলাম। এই দৃশ্য জীবনভর চোখে লেগে থাকবে। চোখ থেকে মুছবে না কোনো দিন।
হুমায়ূন ভাইয়ের মতো চাঁদপাগল মানুষ আমি দেখিনি। প্রখর জ্যোৎস্না মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর করত তাকে। তার কোনো কোনো লেখায় জ্যোৎস্নার বর্ণনা পড়লে মন অন্যরকম হয়ে যায়। যে কোনো পাঠক চাঁদপাগল হয়ে যাবে সেই বর্ণনা পড়লে।
তিনি লিখেছিলেন, 'চান্নি পশর রাইতে যেন আমার মরণ হয়'। তার মৃত্যুর দিনটিতে আকাশে চাঁদ ছিল কি না মনে নেই। তখন আমি এক ঘোরের মধ্যে। প্রতিদিন নিউইয়র্কে ফোন করছি, মাজহারের সঙ্গে কথা বলেছি, আর বিষণ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অফিসের কাজেও মন নেই। তারপর তার চলে যাওয়া, দেশের কোটি মানুষের কান্না, হাহাকার।
এখনো সেই হাহাকার মানুষের মনে। এবারের বইমেলায় তার বইয়ের বিক্রি আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বহু মুদ্রণ হওয়া, বার বার পড়া বইগুলোও গাদা গাদা কিনে নিয়ে গেছেন পাঠকরা। এমন পাঠক মুগ্ধ করা লেখক বাংলা ভাষায় আর কে জন্মেছেন!
কোনো কোনো গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। বসুন্ধরার যে ফ্ল্যাটে থাকি তার দুই পাশে সুন্দর বারান্দা। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই নির্জন মধ্যরাতে। কোথাও কেউ জেগে নেই। আকাশে জেগে আছে পূর্ণ কিংবা একটুখানি ক্ষয় হওয়া চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ভাসছে বসুন্ধরার মনোমুঙ্কর আবাসিক এলাকা, দূরের কাঁশবন, খোলা মাঠ। সেই দিকে তাকালে মনে পড়ে হুমায়ূন ভাইয়ের কথা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার একটা প্লট আছে। বাড়ি করে এখানে এসে থাকার ইচ্ছা ছিল। তার আগেই চলে গেলেন। ঘুমভাঙা রাতের চাঁদ আর জ্যোৎস্নার দিকে তাকালে মনে পড়ে এ রকম চাঁদ আর জ্যোৎস্নায় প্রিয় মানুষটি নেই।
জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া রাত, গাছের পাতা, ঝোপঝাড় আর মানুষের ঘরবাড়ি মাতিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়া, শ্রাবণের তুমুল বৃষ্টি, নুহাশ পল্লীর সবুজ ঘাস, পুকুরের জল আর ঔষধি বাগান সব রয়ে গেল যে যার মতো, শুধু হুমায়ূন আহমেদ নেই।
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে তার মুখখানি আমি দেখি। রাত কেটে যায় রাতের মতো।
তারপরই মনে হয়, কে বলেছে হুমায়ূন ভাই নেই। এই যে বুকসেলফজুড়ে তার এত বই, টেলিভিশনে তার এত নাটক, সিনেমা হলে তার সিনেমা, বিখ্যাত গায়ক-গায়িকার মুখে মুখে তার এত গান আর কোটি পাঠকের হৃদয়জুড়ে তার আসন, তিনি তো সর্বত্রই রয়ে গেছেন, শুধু তার সঙ্গে আর দেখা হয় না, এই যা।

-ইমদাদুল হক মিলন
May be an image of 5 people, dais and text that says "৬২তম জন্মদিন উপলক্ষে কিংবদন্তী কথাশিল্পী হমায়ূন আহমেদের কক বইমে র উদ্বোধন মুনশি' ও 'ব প্রকাশনা উৎসব ০১০, পার্ক GRGINAL AW মায়ুন আহনত"
All reac
ছবিঃ সংগৃহীত 
Previous Post Next Post

نموذج الاتصال