গতকল্য ভোরে সন্ন্যাস হইয়া গিয়াছে। রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় মহারাজ ধ্যান হইতে উঠিলেন।
আটজন নূতন সন্ন্যাসীর মধ্যে তিনজনকে উপস্থিত দেখিয়া, মহারাজ কহিলেন, কিরে তোদের তো কালও ভিক্ষার নেমন্তন্ন আছে, আমার কাছে বলে গেছে।
বি—আমার একদিন মাধুকরী করে খাবার ইচ্ছা।
মহারাজ। বেশ তো। একদিন কেন, পারলে তিনদিনই খেতে হয়। যা হচ্ছে খাওয়া, এ তো আর সেরকমই নয়। সন্ন্যাসের মন্ত্রগুলোর মানে জগদানন্দের কাছ থেকে জেনে নিয়ো।
দেখলে তো, সব মন্ত্র কিরূপ? ঐ সমস্ত ত্যাগ করেচ, এখন কেবল পরব্রহ্মের চিন্তা কর। মহাবাক্যই হচ্চে, ‘অহং ব্রহ্ম স্মি’।
ব্রহ্মচর্য থেকে সন্ন্যাস নিয়েচ, এর মানে কী? ব্রহ্মচর্যের নিয়মগুলো কি শিকায় তুলে রেখে দিতে হবে?—তা নয়।
সেগুলোও করতে হবে। সেগুলো এত অভ্যাস হয়েচে যে আর চেষ্টা করে করতে হচ্চে না, আপনা আপনি অভ্যাসগুণে হচ্চে।
দেখ না, ব্রহ্মচারী যে এত হয়েচে, ক’টা সে মন্ত্রগুলো স্মরণ করে। অনেকে মানেই জানে না। অনেকে কয়টি মন্ত্র, তাই জানে না। সন্ধ্যার সময় বসে সারাদিন কী করলুম চিন্তা করতে হবে, মনকে পরীক্ষা করতে হবে। তোমরা ‘প্রেষ’ স্মরণ করবে। যদি দেহবুদ্ধি আসে, তখন ‘আমি তাঁর দাস—তাঁর সন্তান—তাঁর অংশ’—ভাবনা করবে।
ক—। মহারাজ, গায়ত্ত্রী জপ করতে হবে?
মহারাজ। পরমহংস-গায়ত্ত্রী? পরমহংস-গায়ত্ত্রী জপ করা ভাল। পূর্বে ভাবতে, ‘সূর্যমণ্ডলের মধ্যস্থিত পুরুষ’ আর এর মানে হল,—তোমার ভিতর তিনি। তুমিই সেই, আর কি। তিনিই সব সময় প্রেরণ করচেন। একবার, পারলে দশবার জপ কোরো।
রা—। আমাদের কি তিনদিন আগুন ছুঁতে নাই।
মহারাজ। (ঠাট্টা করিয়া) হ্যাঁ, তামাক পর্যন্ত না!
রা—। না মহারাজ, আমরা অনেকের কাছে শুনি যে তিনদিন আগুন ছুঁতে নাই; তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করচি। এতক্ষণ তো ঘরে অন্ধকারে ভূতের মত বসেছিলুম।
মহারাজ। হ্যাঁ, ছুঁতে নাই! দাঁতন করার যো নাই, সর্বভূতকে অভয় দিয়েচি কিনা! আগুন ছুঁতে নাই, এ করতে নাই, ও করতে নাই—এতে যত মন দেবে। অত কী দরকার?
তোমার ভগবানের চিন্তা নিয়ে কথা।
যে যত সেই পরব্রহ্মের ধ্যান করতে পারবে, সেই জিতবে।
তা না হলে, লাল কাপড়, আধ পয়সায় রাঙানো, পরে ভিক্ষার সুবিধা আর পেন্নাম নেবার সুবিধা হবে।
আগেকার বৈদিক সন্ন্যাস কত কঠোর ছিল। সন্ন্যাস নিয়ে উত্তরাভিমুখে চলে যেত। যাচ্ছে—যাচ্ছে—কিছুদিন বাদে এক সময় শরীরটা চলে যেত। এখন হচ্ছে বিবিদিষা-সন্ন্যাস।
সেই পরব্রহ্মের তত্ত্ব পাবার বাসনা, চেষ্টা।
তা সন্ন্যাস নিয়ে ক’টা লোক করচে?
কেবল পরচর্চা আর পরনিন্দা! ঐ একটা আছে কি বি—শুভানন্দ আজ এসে নালিশ করছিল।
সন্ন্যাস নিয়ে কোথায় ভগবানের চিন্তা করবে, তা নয়।
ফষ্টিনাষ্টি করা, কার বিরুদ্ধে কী বলা, এর কথা তার কাছে—এই সব।
সন্ন্যাস নিয়ে কোথায় সাধনভজনে ডুবে যাবে,—disobedience (অবাধ্যতা)! কথা শুনব না, superiorরা (গুরুজনরা) যা বলেন তা করব না, নিজের দোষটা ঘাড়ে নেব না।
আমার দোষ নাই—কেবল আপনাকে defend (সমর্থন) করা।
উনি অমুক, তিনি অমুক।
বিদ্যাপীঠেঅমুক আমাকে সময় দিতেন না। সব সুবিধাবাদী।
ভোরে উঠে নিজে কিছু করবে না, কেবল ঐ সব।
ঐরকম ঐ বেটা রা—টারও আছে। আমি এইগুলিকে কিছুতেই সন্ন্যাস দিতুম না—মহাপুরুষ না বল্লে আমি দিতুম না।
যেন ক্লাস-প্রমোশন—কেঁদেকেটে ক্লাস-প্রমোশন।
ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যের ‘স্বামী সারদানন্দের জীবনী’ হইতে।
সংগ্রহেঃসনৎ ধর মিতুল
Tags
hindu