'কারার ওই লৌহ কপাট' গান নিয়ে বিতর্কে ক্ষমা প্রার্থনা নির্মাতাদের

'কারার ওই লৌহ কপাট' বিদ্রোহী কবির বহুল প্রচলিত গান, সুর বদলে দেওয়া হয়েছে সেটিরই

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিত গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ একটি হিন্দি সিনেমায় ব্যবহার নিয়ে ভারত আর বাংলাদেশে ব্যাপক বিতর্কের মুখে নির্মাতারা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। যদিও তারা এটাও উল্লেখ করেছে যে সিনেমায় গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেছিল কবির পরিবারের সঙ্গে।

অস্কারজয়ী এ আর রহমানের সংগীত পরিচালনায় যেভাবে গানটি এখন উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতেই আপত্তি তুলেছে নজরুল পরিবার ও বহু সাধারণ মানুষ।

বিতর্ক তৈরি হওয়ার পরে কবি পরিবারের মধ্যে থেকে দাবি উঠেছে, যে চুক্তি অনুযায়ী গানটি সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হোক।

যে হিন্দি ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘পিপ্পা’ নামের সেই সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এআর রহমান।

কিন্তু কথা ঠিক রাখলেও গানটির আসল সুর বদল করায় এ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

বিতর্ক শুরু হওয়ার পর সোমবার প্রথমবারের মতো তাদের বিবৃতি দিয়েছে সিনেমাটির প্রযোজকরা।

প্রযোজকদের তরফে একটি স্বাক্ষরবিহীন বিবৃতি পৌঁছিয়েছে সংবাদ মাধ্যমের কাছে, যেখানে তারা লিখেছে যে তারা গানটিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে, “তা যদি ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে থাকে অথবা অনিচ্ছাকৃত পীড়া দিয়ে থাকে, তাহলে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি।“

ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেও তারা কিন্তু এটা উল্লেখ করছে যে পরিবারের কাছ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে, লিখিত চুক্তি করেই তারা গানটি ব্যবহার করেছিল।

তারা এও লিখেছে যে তারা যেভাবে গানটিকে উপস্থাপন করেছে, সেটি ছিল "একটা আন্তরিক শৈল্পিক প্রচেষ্টা, যার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় 'অ্যাডাপ্টেশন রাইট' (অর্থাৎ ছবির প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করার স্বত্ত্ব) নেওয়া হয়েছে।"

কবি নজরুল ইসলামের পরিবার অভিযোগ করেছে, তাদের কাছ থেকে গান ব্যবহারের অনুমতি নেয়া হলেও যেভাবে সুর বদল করা হয়েছে, সেই অনুমতি তারা দেননি। সম্ভব হলে গানটি তারা ওই সিনেমা থেকে বাদ দিয়ে দেয়ারও দাবি করেছেন।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

প্রসঙ্গত, গানটির কথায় ‘কপাট’ শব্দটি বহুল প্রচলিত হলেও ১৯৪৯ সালে যে প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল, সেখানে শব্দটি ছিল ‘কবাট’। এক নজরুল গবেষক অবশ্য বলছেন কবি ঠিক কী লিখেছিলেন, তা জানার উপায় নেই, কারণ তার হাতে লেখা কবিতাটি সংরক্ষণ করা নেই।

গবেষক অর্ক দেবের কথায়, “২৫ বছর গানটি গণস্মৃতিতে ছিল। সেকারণে কপাট ও কবাট দুটোই রয়েছে। একটা অন্যটার অপভ্রংশ, আর তা ভাষার মান্য ঘটনাই। “

যে হিন্দি ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘পিপ্পা’ নামের সেই সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এআর রহমান।

নজরুল পরিবারের ক্ষোভ

বহুল প্রচলিত ওই গানটি সিনেমায় ব্যবহারের জন্য ২০২১ সালে প্রযোজনা সংস্থা ও কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। বিনিময়ে পরিবার দুই লক্ষ টাকা রয়্যালটিও পেয়েছিল।

তবে তার পরিবার বলছে ওই চুক্তি অনুযায়ী কখনই কাজী নজরুলের গানটির সুর 'বিকৃত' করার অনুমোদন দেওয়া হয় নি।

কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী এবছর মে মাসে মারা গেছেন।

“ওই চুক্তিতে সাক্ষী হিসাবে আমি ছিলাম, কিন্তু সেখানে কোনভাবেই সুর বা কথা বদলানোর অনুমতি আমার মা দেন নি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কবি নজরুলের নাতি ও কল্যাণী কাজীর ছেলে কাজী অনির্বাণ।

কাজী অনির্বাণ বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, “বছর দুয়েক আগের ওই চুক্তির কথা আমাদের মাথাতেও ছিল না। ইতিমধ্যে মা মারা যান এ বছরের ১২ই মে। হঠাৎই কয়েকদিন আগে প্রযোজনা সংস্থা থেকে আমাকে গানটির লিঙ্ক পাঠিয়ে শুনে নিতে অনুরোধ করা হয়। আমি তো গানটার উপস্থাপনা শুনে আকাশ থেকে পড়ি, এটা কী করেছেন এআর রহমান!”

তিনি বলেন, “মা ভেবেছিলেন এআর রহমানের মতো বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক গানটা ব্যবহার করলে তা বিশ্বব্যাপী একটা প্রচার পাবে। সেজন্যই বিশ্বাস করে দাদুর গানটা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। এমন কি এটাও বলেছিলেন মা যে, গানটা তৈরি হওয়ার পরে যেন আমাদের শোনানো হয়। এটা স্পষ্টতই চুক্তি ভঙ্গ।“

এই বিতর্ক শুরু হওয়ার পর চুক্তিটি প্রকাশের দাবি তুলেছেন নজরুল পরিবারের আরেকজন সদস্য।

কাজী অনির্বাণের বোন, কবি নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজী যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “এরকম একটা যে চুক্তি যে হয়েছিল, এআর রহমানের মতো একজন সঙ্গীত পরিচালক দাদুর গান নিয়ে কাজ করবেন, এত বড় খবরটা মা বা দাদারা কেউ আমাকে গত দুবছরে জানালেন না! মায়ের যে ছাত্রীদের সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতেন, তাদেরও মা কিছু জানালেন না! এটাই আমাকে অবাক করছে।

“ওই চুক্তিটা প্রকাশ কেন করছেন না আমার দাদা? চুক্তিটা সামনে এলেই তো স্পষ্ট হয়ে যাবে সব কিছু। দাদুর গানের সুর বদল করার বা ‘রিক্রিয়েট’ করার অনুমোদন দেবেন আমার মা, এটা অবিশ্বাস্য,“ বলছিলেন অনিন্দিতা।

সুর বদলের প্রতিবাদ করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের ঢাকায় বসবাসরত নাতনি খিলখিল কাজীও।

তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলেছেন, যেভাবে এআর রহমান গানটির সুর বদল করেছেন, তা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। একে 'অপরাধ' হিসাবে তিনি বর্ণনা করেছেন।
কবির জন্মস্থান চুরুলিয়া গ্রাম

'ইতিহাসের বিকৃতি'

কবির পরিবারের সদস্য এবং নজরুল বিশেষজ্ঞরা অস্কার জয়ী সঙ্গীত পরিচালক এআর রহমানের এই কাজকে ইতিহাসের বিকৃতি বলে মনে করছেন।

নজরুল পরিবার বলছে, কবির সৃষ্টি বদলিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই।

কবির আরেক পৌত্র কাজী অরিন্দমের কথায়, “এআর রহমানের মতো একজন সঙ্গীত পরিচালক এরকম একটা গর্হিত কাজ কী করে করলেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। শুধু যে ভাবাবেগে আঘাত তা নয়, কারার ওই লৌহ কপাট তো একটা আন্দোলন-সংগ্রাম, যার জন্য আমাদের দাদুকে অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছিল, সেই ইতিহাস বিকৃত করে দেওয়া হল।“

ভারতের আইন অনুযায়ী, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুলের সব সাহিত্য কীর্তির কপিরাইট তার পরিবারের হাতে রয়েছে।

নজরুল পরিবারের এখন দাবি, সিনেমায় তাদের পরিবারের প্রতি যে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে, সেটা যেন টাইটেল থেকে তুলে নেওয়া হয় আর সম্ভব হলে গানটিকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হোক সিনেমা থেকে।

কিন্তু যদি প্রযোজনা সংস্থা চুক্তি ভঙ্গ করে থাকে, সেক্ষেত্রে তারা আইনী ব্যবস্থা নেবেন কী না, তা স্পষ্ট নয়।

এআর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের গানের সুরের বদল করায় আপত্তি জানিয়েছে কবির পরিবারের সদস্যরা

কীভাবে সুর দিয়েছেন এআর রহমান?

যে গানটি ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে, তার গোড়ায় কিছুটা লোকসঙ্গীতের যন্ত্রানুষঙ্গ রয়েছে, তারপরেই সমবেত কণ্ঠে, অপরিচিত সুরে গাওয়া হয়েছে কারার ওই লৌহ কপাট গানটিকে।

সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই মন্তব্য করছেন যে গানটির মূল ভাবটাই সম্ভবত ধরতে পারেন নি অস্কার জয়ী সুরকার।

কলকাতার শিল্পী বাবজী সান্যাল বলছেন, “এই গানটি অথবা রবীন্দ্রনাথ – নজরুলের গানগুলোর সঙ্গে তো মানুষের ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে। মি. রহমান যেভাবে সুর করেছেন, তার সঙ্গে গানটির ইতিহাস, প্রেক্ষিত এগুলো একেবারেই মেলে না। তিনি গানটিকে আধুনিক করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষমেশ এই বিখ্যাত গানটির একটি বিকৃত রূপ সামনে এনেছেন।“

নব্বইয়ের দশকে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন ঢাকার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মাকসুদুল হক। তবে তিনিও সুর বদলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

মাকসুদুল হক বলছেন, “কোনও পরিচিত গানের সুরটা ঠিক রেখে কেউ যদি যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায় সেটা করতেই পারে। কিন্তু সেই পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি সুরটা ধ্বংস হয়ে যায়, তাতে মানুষের কাছে আপত্তিকর মনে হতেই পারে।“

সামাজিক মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক

সেনাবাহিনী থেকে ফেরার কিছুদেনের মধ্যের কাজী নজরুল রচনা করেন গানটি

সিনেমার গানটি ইউটিউবে আপলোড হতেই এ নিয়ে ভারত আর বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা সঙ্গীত পরিচালক এআর রহমানের তুমুল সমালোচনা শুরু করেছেন ।

বেশিরভাগই তাকে দুষছেন বহুল প্রচলিত সুরটি বদলিয়ে ফেলার জন্য। আবার গানটি গেয়েছেন যে বাঙালী শিল্পীরা, তাদেরও দোষারোপ করা হচ্ছে।

গায়িকা ফাহমিদা নবী লিখেছেন, ''এ আর রহমান নিজেই গুনি সুরকার।নিজের সুরে অন্য কথায় ছবির প্রয়োজনের গান করতেই পারতেন। সঠিক সুরে গানটি ব্যবহার করতে পারতেন।আমাদের জাতীয় কবির প্রতি এই অসম্মানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।''

লেখিকা তামান্না ফেরদৌস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ''এ আর রহমানের সুর করা লৌহ কপাট গানটা শুনে মনে হলো, এই গান এবং এই গানের সাথে জড়িয়ে থাকা বাঙালির আবেগ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই কিংবা থাকলেও উনি সেভাবে আমলে নেননি। একজন অস্কার বিজয়ী শিল্পীর কাছ থেকে এই ধরনের উদ্ধতপূর্ণ অপেশাদার আচরন কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।''

''উনার অবশ্যই তার এই অপেশাদার আচরনের জন্য পুরো বাঙালি জাতির কাছে ক্ষমা এবং দুঃখ প্রকাশ করা উচিৎ।''

নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা টেলিভিশন চ্যানেল আইকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ''নতুনের কাজ নতুন কিছুই হবে, এটি যদি একধরনের ফিউশনও হতো, তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু গানটি এতটাই আলাদা, হঠাৎ করে সুর শুনলে বুঝবোই না এটা কোন গান ছিল। আইডেন্টিফিনেশনের যদি সমস্যা হয়ে যায়, তাহলেই প্রশ্ন এসে যায়।...নজরুলের গান নিয়ে তিনি কাজ করে, এর চেয়ে ভালোলাগার কিছু ছিল না। যখন গানটির কথা ঠিক ছিল নজরুলের ভাষায়, সুর হয়ে গেছে আলাদা কিছু, এখানেই যত সমস্যা।''

তবে ভিন্ন মতও দেখা যাচ্ছে একটু খোঁজ করলে। এই অংশটির কারও কাছে এআর রহমানের দেওয়া সুরটি খারাপ লাগে নি, কেউ বলছেন শিল্পীর স্বাধীনতা আছে যে কোনও গান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর।

কলকাতার এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ও সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী যেমন উদাহরণ দিয়েছেন ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটির সুর তো দিয়েছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক! তিনি লিখেছেন, “অসুবিধা কোথায়? একটা ভালো লেগেছে, একটা লাগেনি। ব্যাস। খারাপ লাগলে শুনবেন না।


“নজরুলের লেখা কবিতায় কেউ নতুন করে সুর চাপিয়েছেন, তা নিয়ে এমন মায়াকান্না কেন? কেন ব্যক্তি আক্রমণ? পছন্দ না হলে বলুন। সমালোচনা করুন। পারলে রহমানকে সুর সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞান ঝাড়ুন। কিন্তু এই হাহাকার, বাঙালির সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ চাগিয়ে ওঠার কারণ কি?

আবার বাংলাদেশ থেকে তানিয়া নূর তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “একটা গান বাজে করে কেউ গাইলেই আমাদের গেলো গেলো মাতম ওঠে কারণ আমরা নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান!! নজরুলের গান একজন ভিনদেশী ভিনভাষী কম্পোজার নতুন সুরে বাঁধলে নজরুলকে অপমান করা হবে বলে যারা মনে করছেন ... আমার মনে হয় না আপনারা নজরুলের ব্যাপকতা বুঝতেও পেরেছেন। নজরুলের প্রতিটা কাজ যদি যথাযথ সংরক্ষণ করে বিশ্ব দরবারে পৌঁছিয়ে দেয়া যেতো তাহলেই তাঁকে যথার্থ সম্মান জানানো হত।“

এই বিশ্লেষণ দেওয়ার পরে তানিয়া নূর অবশ্য এটাও লিখেছেন যে এআর রহমানের সুর দেওয়া গানটা তার “একদম ভালো লাগে নি।“

বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক ব্রাত্য রাইসু বলছেন, গানটির “১০২ বছর হইছে বয়স। কাজেই এখন এই গান যে কোনো সুরে যে কেউ গাইতে পারে। এমনকি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরেও। সেইটা বন্ধ করার দাবি খারাপ দাবি।

“তা আপনারা এআর রহমানের নাকি সুরের লৌহ-কপাট শুইনা বইসা আছেন কেন? ‘নজরুলের সুরের’ গানটা শেয়ার করলেই পারেন,” ফেসবুকে লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু। এটাও উল্লেখ করেছেন তিনি যে এআর রহমানের গান তার কখনই ভাল লাগে না।

বাংলাদেশের নাট্য ব্যক্তিত্ব রৌনক হাসানের প্রথমবার গানটা শুনে ভালো না লাগলেও কয়েকবার শোনার পরে অতটাও খারাপ মনে হয় নি।

তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, “দ্রোহটা একটু কমেছে এইযা! সিনেমাতে কোন প্রেক্ষিতে গানটা ব্যবহার হয়েছে সেটাও বিবেচ্য।“

মি. হাসান আরও লিখেছেন, “এটা নিয়ে এতোটা বিক্ষুব্ধ না হয়ে আমরা এটাকে অগ্রাহ্য করতে পারি। কিন্তু এতোটা বিক্ষুব্ধ হলে ভবিষ্যতে নানা বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেইতো কেউ সাহস পাবে না।“
কারার ওই লৌহ কপাটের প্রথম রেকর্ড - অর্ক দেবের সংগ্রহ থেকে

ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের গান

কাজী নজরুলের জীবন নিয়ে, বিশেষ করে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ – এই এক দশক নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গবেষণা করেছেন অর্ক দেব।

ওই সময়েরই রচনা ‘কারার ওই লৌহ কপাট’।

মি. দেব বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে কবি তখন কলকাতার কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলে থাকতেন। তার সঙ্গে বাস করতেন কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমেদ। সেই সময়ের ইতিহাস থেকে আমি যা পেয়েছি, তা হল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে কারা ওই লৌহ কপাট গানটি একটা কবিতা হিসাবে রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল।“

“প্রেক্ষিতটা এরকম ছিল : ১৯২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর দেশবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। তিনি ‘বাঙ্গালার কথা’ নামে যে পত্রিকা চালাতেন, সেটার দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী। কবি নজরুল চিত্তরঞ্জন দাসের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পত্রিকার দায়িত্ব নিয়ে বাসন্তী দেবী ঠিক করেন যে পরের সংখ্যায় দেশবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রচনা ছাপাবেন। সেই সূত্রেই কাজী নজরুলকে একটা লেখা দিতে বলেন বাসন্তী দেবী। তিনি একটা চিরকূটে এই কবিতাটি লিখে সুকুমার রঞ্জন দাস নামে এক ব্যক্তির হাত দিয়ে বাসন্তী দেবীর কাছে পাঠান,” জানাচ্ছিলেন নজরুল গবেষক অর্ক দেব।

‘বাঙ্গালার কথা’ পত্রিকার নামটা এইভাবেই ছাপা হত।

“বাঙ্গালার কথা পত্রিকার ১৯২২ সালের ২০শে জানুয়ারি সংখ্যায় এটা ছাপা হয়েছিল। তার মানে ১৯২১ এর ডিসেম্বরের শেষ থেকে পরের বছরের জানুয়ারির প্রথম দু সপ্তাহের মধ্যে কোনও একটা সময়ে এটা রচিত হয়। সেই সময়ে কবির বয়স ২২ বছর ছয় মাস। ‘ভাঙার গান’ বইতে ১৯২৪ সালে এটি সংকলিত হয়েছিল। এটার সুর যদি খেয়াল করে দেখেন, এর মধ্যে একটা ‘ট’ এর অনুপ্রাস ব্যবহার করেছিলেন তিনি, যেটা সাধারণত আমরা র‍্যাপ সঙ্গীতে দেখে থাকি,” বিশ্লেষণ অর্ক দেবের।
'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন' ছবির পোস্টার - অর্ক দেবের সংগ্রহ থেকে

'ভাঙার গান'এ প্রথম সংকলিত

তিনি বলছিলেন, “র‍্যাপ তো সবসময়েই প্রতিবাদের সুর, নজরুলও তো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সেই প্রতিবাদী ছন্দ, মানুষের মনকে আন্দোলিত করার ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। আবার তিনি সদ্য সেনাবাহিনী থেকে ফিরেছেন, তাই এই গানের সুরে আমরা একটা মার্চিং সং-য়ের তালও পাই। দ্রুতলয়ের দাদরা ব্যবহার করা হয়েছিল গানটির সুরে।“

যে বইতে গানটি প্রথম সংকলিত হয়েছিল, সেই ‘ভাঙার গান’ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।

তাই ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত কোনও লিখিত সংকলনে গানটি ছিল না।

অর্ক দেব বলছিলেন, “প্রায় ২৫ বছর কিন্তু গানটার সুর মানুষের মনেই গেঁথে গিয়েছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু থেকে শুরু করে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী জেল বন্দী অবস্থায় নিয়মিত এই গানটা গাইতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৯ সালে গানটা প্রথম রেকর্ড হল। গিরীন চক্রবর্তীর গলায় সেই রেকর্ড বেরল ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে আর সেবছরই ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছায়াছবিতে প্রথমবার ব্যবহৃত হয় গানটি। সেটাও গিরীন চক্রবর্তীর গলাতেই।“

“এই গানটার সঙ্গে জড়িত গোটা ইতিহাসটাই বিকৃত করে দেওয়া হল। এআর রহমানের গানের যে প্রচার, সেটা তো সারা বিশ্বে এখন ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম বিকৃত সুরে কাজী নজরুলের এই কালজয়ী গানটি শুনবে, তারা হয়তো এটাকেই নজরুলের দেওয়া আসল সুর বলে মনে করতে থাকবে,” বলছিলেন অর্ক দেব।

কাজী নজরুলের গানের সুর বদল করা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ এআর রহমানকে দুষছেন। তবে কবি-পৌত্র কাজী অনির্বাণ থেকে শুরু করে নজরুল গবেষক অর্ক দেবের মতো অনেকেই বলছেন যে মি. রহমান তো বাংলা জানেন না, তিনি গানটির সঠিক ভাবটা ধরতে ব্যর্থ হতেই পারেন।

“কিন্তু গানটা যারা গেয়েছেন, তারা তো বাঙালী, তারা তো বলতে পারতেন যে গানটার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কী, আসল সুর কোনটা। সেটা বলার তাদের সাহস হল না?” প্রশ্ন কাজী অনির্বাণের।

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময়কার একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরি হয়েছে - ফাইল চিত্র

৭১-এ গরীবপুরের যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে সিনেমা

কারার ওই লৌহ কপাটের সুর-বিকৃতি করা হয়েছে যে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটিতে, সেটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের একটা সত্য ঘটনা।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহেতার লেখা তার স্মৃতিকথা ‘দ্য বার্ণিং চ্যাফিস’ -অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এম২৪ চ্যাফিস ট্যাঙ্ক সেই সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যবহার করত।

‘গরীবপুরের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত ভারত আর পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রনের ভয়াবহ সেই যুদ্ধের কথা ব্রিগেডিয়ার মেহেতা তার বইতে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই তা গ্রন্থিত হয়েছে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ এর ষষ্ঠ খণ্ডে।

‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’-এ লেখা হয়েছে, “যশোর সেনানিবাস থেকে ১১ কিলোমিটার এবং ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত অখ্যাত গ্রাম গরীবপুর।

“গরীবপুরে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়,” লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কোষে।

ওই যুদ্ধে রাশিয়ায় তৈরি পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রনের প্রধান মেজর দলজিৎ সিং নারাং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়ার পরেই বাহিনীর দায়িত্ব বর্তায় ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহেতার ওপরে।

সম্মুখ সমরে পাকিস্তানী স্কোয়াড্রনের ১৪টি ট্যাঙ্কের সবগুলি ধ্বংস করে ভারতীয় বাহিনী। পাকিস্তানী বাহিনীর বহু সৈন্যও নিহত ও আহত হন, আর ভারতীয় বাহিনীর ১৯ জন নিহত, ৪৪ জন আহত হন ও দুটি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়, লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কোষে।

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে ‘গরীবপুরের যুদ্ধ’-এ ভারতীয় বাহিনীর প্রধান, পরে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হওয়া বলরাম সিং মেহেতা মন্তব্য করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই তিনি সহযোদ্ধাদের কথা দিয়েছিলেন যে তাদের অসম সাহসী এই যুদ্ধের বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করবেন।

যুদ্ধজয়ের বহু বছর পরে, ২০১৫ সালে যখন তার ইউনিটের ৫০ বছর পার হল, তখনই তিনি গরীবপুরের যুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিকথা ‘দ্য বার্ণিং চ্যাফিস’ লেখেন।

তার ওপরে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি।

Source: BBC News Bangla
Previous Post Next Post

نموذج الاتصال