বাংলাদেশে কি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসবে?

ছবি: সংগৃহীত

গত কয়েকমাসে দেশে একটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তা হলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জনমনে ইতোমধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রথমে ছিল নিষেধাজ্ঞা, পরে ভিসানীতি এরপর এখন আলোচনায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। দেশে কি আসলেই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসবে? তার আগে চলুন জেনে নিই- নিষেধাজ্ঞা কী? কেন দেওয়া হয় এবং দিলে কী হয়?

নিষেধাজ্ঞা কী, কেন দেয়?

নিষেধাজ্ঞা মূলত- একটি দেশ অপর একটি দেশের ওপর শাস্তি স্বরুপ। অর্থ্যাৎ একটি দেশ অন্য দেশকে শাস্তি হিসেবে নিষেধাজ্ঞা দেয়। যেমন- যদি কোনো দেশের প্রতি রাগান্বিত হয় বা সেই দেশের আচরণ সংশোধন করতে চায় তাহলে অনেক দেশ নিষেধাজ্ঞা দেয়। আবার অনেক সময় এক দেশ আরেক দেশের ওপর প্রতিশোধ হিসেবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে।

এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব স্যালফোর্ড এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মরটিজ পিয়েপার গণমাধ্যমকে বলেছেন ‘একটি দেশ আরেকটি দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কারণ ওই দেশের আচরণে পরিবর্তন দেখতে চায়’।

নিষেধাজ্ঞার ফলে কী হয়


নিষেধাজ্ঞা একটি কঠিন বিষয়। যারা এর আওতায় পড়ে তারাই ভালো বুঝবে। তবে আমরা দুএকটি উদাহরণ দিতে পারি। ইউক্রেন-রাশিয়ায় এখনো যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধ নিয়ে এরইমধ্যে বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত। এই যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে রুবলের ব্যাপক দরপতন ঘটে এবং বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় এখন বাণিজ্যের করুণ দশা।

আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়, এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরঞ্জাম নিয়ে আসে রুশ পণ্যবাহী একটি জাহাজ। সেই জাহাজটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ছিল। যার ফলে নাম এবং রং পাল্টেও জাহাজটি বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে পারেনি। এমন কী ভারতেও সাহস পায়নি মাল খালাসের।

এছাড়াও রুশ ব্যাংকগুলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন এখনও বন্ধ রয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন করতে পারছে না।

বাংলাদেশে ভিসা নিষেধাজ্ঞা


মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। সেই সময় থেকে এখনও আলোচনায় নিষেধাজ্ঞা।

এদিকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশি কিছু নাগরিকের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে কারো নাম উল্লেখ করা না হলেও যাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে তারা হলেন- বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচারবিভাগের সদস্য এবং নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য।

যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে সেসব ব্যক্তি তা তাদের পরিবারের সদস্যরা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কি আসবে?


‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’ বা ‘ইকোনমিক স্যাংশন’ শুনে পাঠক প্রথমেই ভাববেন এটা মূলত অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ। হ্যাঁ ঠিক তাই। কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় অন্য যে কোনো দেশকে এই নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসছে এমন একটি লেখা লিখেন এক সিনিয়র সাংবাদিক। যেখানে বলা হয়, কিছুদিনের মধ্যেই দেশে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসবে। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হয়। তবে এসব বিষয়কে উড়িয়ে দিয়েছেন সরকারের দায়িত্বশীল কর্তারা।

‘আসছে মার্কিনি ঝড়’ শিরোনামে ওই লেখা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, মাথায় ‘গণ্ডগোল’ থাকার কারণে এগুলো ‘বানাচ্ছে’ সাংবাদিকরা।

তিনি বলেন, পত্রপত্রিকাতো একটু বাড়ায়া বলে। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী এবং অনেক আইনপ্রণেতার সাথে আমাদের বেশ কিছুদিন ধরে অনেক যোগাযোগ হচ্ছে, একজনও বলে নাই, যে ঝড় আসবে। আপনারা এগুলো বানান, আপনাদের মাথামগজের মধ্যে কিছু গণ্ডগোল আছে, এজন্য। তারা চায় একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, এর চেয়ে বেশি কিছু তারা চায় নাই। তারা কেউ বলে নাই কখনও যে, কেয়ারটেকার হবে, শব্দই কারও মুখ কখনও উচ্চারিত হয় নাই।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তো দূরের কথা, কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও আশঙ্কা নেই। মূলত মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করতে এটি প্রচার করা হয়েছে। সেই ভয়ভীতি কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী ফায়দা লুটতে পারে।

এছাড়া একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোথায় নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন), কোথায় ভিসানীতি তলে তলে আপস হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই; সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা এমন ভারসাম্য সবার সঙ্গে করে ফেলেছেন; আর কোনো চিন্তা নেই। ইলেকশন হবে যথাসময়ে।

তবে সকল ধরনের জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এখনও চলছে আলোচনা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা রাজনীতিবীদদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। সবশেষ গত ৭ অক্টোবর বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণে আসে মার্কিন একটি প্রতিনিধিদল। এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। এখন তাদের আলোচনার ফলাফলের ওপরেই নির্ভর করবে বাংলাদেশে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে কি না। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সূত্র: আমাদের সময়

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال