জীবন্ত কিংবদন্তি সৃজনী ও উদ্ভাবনী প্রতিভার প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ারের ৮৩তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা



মুস্তফা মনোয়ার, বাংলাদেশের একজন গুণী চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশে নতুন শিল্প আঙ্গিক পাপেটের বিকাশ, টেলিভিশন নাটকে অতুলনীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন, শিল্পকলার উদার ও মহৎ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা, দ্বিতীয় সাফ গেমসের মিশুক নির্মাণ এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনের লালরঙের সূর্যের প্রতিরূপ স্থাপনাসহ শিল্পের নানা পরিকল্পনায় তিনি বরাবর তাঁর সৃজনী ও উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে একটা এনিমেশন কোর্সে বক্তৃতা দেয়ার সময় কথাটা প্রখ্যাত কবি পূর্ণেন্দু পাত্রী বলেছিলেন, "একটা দেশের জন্য একজন মুস্তফা মনোয়ারই যথেষ্ট"। কবি-পরিবারে জন্ম হওয়ায় পারিবারিকজীবন ছায়ায় বসে শিশুকালেই শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, শিশু বয়সেই নরম হাতের ছোঁয়ায় সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতেন তিনি। প্রাকৃতিক দৃশ্য, আর নানা ধরণের কার্টুন ছবি। বরেণ্য এই চিত্রশিল্পী ১৯৩৫ সালের ১ আগস্ট যশোর জেলার মাগুরায় জন্মগ্রহণ করেন। গতকাল ছিলো তাঁর ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ারের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।

মুস্তফা মনোয়ার বা মুস্তাফা মনোয়ার (Mustafa Monowar) ১৯৩৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর যশোর জেলার মাগুরা (বর্তমান জেলা) মহকুমার শ্রীপুর থানার অন্তর্গত নাকোল গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার মনোহরপুর গ্রামে। তাঁর পিতা কবি গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ। মাতা জামিলা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। খুব অল্প বয়সে তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে যখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। মুস্তফা মনোয়ারের শিক্ষা জীবন শুরু হয় কলকাতায়। তিনি প্রথম ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে। পরবর্তীতে তাঁর বাবা হুগলি থেকে বাকুড়া হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে আসার পর প্রথমে ফরিদপুর তারপর স্থায়ীভাবে ঢাকার শান্তিনগরে বাড়ি কিনলেন। মুস্তফা মনোয়ার মাতৃহীন ছিলেন বলে নারায়ণঞ্জে মেজ বোনের বাড়িতে আশ্রয় গাড়েন। সেখানে নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়। নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং কলকাতায় গিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। নারায়ণগঞ্জ স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা শোনেন। ঢাকায় গুলি হয়েছে, বাঙালি শহীদ হয়েছে, পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষা বন্ধ করে দিতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে ছবি আঁকতে শুরু করেন এবং সেই ছবি বন্ধুদের সঙ্গে সারা নারায়ণগঞ্জ শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেন। যার ফলে পুলিশ এসে তাঁর দুলাভাইসহ তাঁকে বন্দী করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। নারায়ণগঞ্জ স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা শোনেন। ঢাকায় গুলি হয়েছে, বাঙালি শহীদ হয়েছে, পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষা বন্ধ করে দিতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে ছবি আঁকতে শুরু করেন এবং সেই ছবি বন্ধুদের সঙ্গে সারা নারায়ণগঞ্জ শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেন। যার ফলে পুলিশ এসে তাঁর দুলাভাইসহ তাঁকে বন্দী করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। পড়ালেখায় মনোযোগ তাঁর কোনদিনই ছিল না। তাঁর ওপর আবার কলেজে ভর্তি হয়েছেন সায়েন্সে, অথচ অঙ্কে ভিষণ কাঁচা। ফলশ্রুতিতে সেখানে পড়াশুনা না করে কলকাতা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এবং ১৯৫৯ সালে তিনি ফাইন আর্টস বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্র অবস্থায় দার্জিলিং বেড়াতে যেয়ে দার্জিলিং এর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ওপর জল রং-এর কতকগুলি ছবি এঁকে সকলকে তিনি অবাক করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন ইউ. এস. আই. এস-এর পরিচালনায় তাঁর ছবিগুলির ওপর ঢাকায় এক প্রদর্শনী হয়। এ প্রদর্শনীই তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম স্বীকৃতি বয়ে আনে।

মুস্তাফা মনোয়ার কর্মজীবন শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরুতেই তিনি সেখানকার স্টেশন প্রডিউসার হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বমুস্তফা মনোয়ারের প্রচেষ্টায় টেলিভিশনের গতানুগতিক অনুষ্ঠানমালার এক আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি জাতীয় পারফর্মিং আর্টস একাডেমী, জাতীয় সমপ্রচার একাডেমী এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম উন্নয়ন কর্পোরেশনের মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি জনবিভাগ উন্নয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৭২ সালে বিটিভি থেকে প্রচারিত শিশু প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে জনপ্রিয় 'নতুন কুঁড়ির' রূপকার তিনি। ১৯৭৩ সালে মুস্তাফা মনোয়ার 'রক্তকরবী' নাটক তৈরি করেছিলেন। মুস্তফা মনোয়ারের উল্লেখযোগ্য শৈল্পিক সৃষ্টি ‘পাপেট’। বাংলাদেশ থিয়েটার পাপেট এন্ড এনিমেশনের তিনি পরিকল্পক, গবেষক ও উদ্ভাবক। তাঁর পাপেট শিল্প সুর, কথা, গান, অভিনয়, চিত্রকলা, কবিতা সব শিল্পকেই ধরে আছে। পাপেট নিয়ে বহুদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। প্রথমবার তিনি তাঁর নিজের পাপেট দলসহ বাংলাদেশের ফোক পাপেট দল ধনমিয়াকে নিয়ে মস্কো ও তাশখন্দ সফর করেন। সেখানে বাংলাদেশের ফোক পাপেট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত তাঁর ‘পাপেট’ এর মাধ্যমে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘ক’ ও ‘খ’ জাপানে ও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের টি. ভি অনুষ্ঠান প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করে। ১৯৮২ সালে তিনি কলম্বোয় ‘এনিমেশন এন্ড পাপেট ফর টেলিভিশন’ বিষয়ক আনত্মজার্তিক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ঢাকায় জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সাফ - গেমসের জন্যে তাঁর উদ্ভাবিত ‘মিশুক’ যা বৃহৎ আকারের চলমান পাপেটরূপে সকলের নিকট জনপ্রিয় ও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর উদ্ভাবিত পাপেট আন্তজার্তিক মানের। যার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যাকে ইউ. এন. আই. এম. এর সদস্যপদ প্রদান করা হয়।

প্রতিবাদী শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেন।নারায়ণগঞ্জ সরকারী হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরণের পোস্টার এঁকে নারায়ণগঞ্জবাসীকে অবাক করে দিয়েছিলেন। এর পুরস্কার স্বরূপ তিনি পেয়েছিলেন পাকিস্তান সরকারের জেল যন্ত্রণা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভারতে অবস্থানকালীন বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী পরিচালনা করেন। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। ১৯৫৭ সালে কলকাতায় একাডেমি অব ফাইন আর্টস আয়োজিত নিখিল ভারত চারু ও কারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রাফিক্স শাখায় শ্রেষ্ঠ কর্মের স্বীকৃতিতে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চারুকলা প্রদর্শনীতে তেলচিত্র ও জলরঙ শাখার শ্রেষ্ঠ কর্মের জন্য দুটি স্বর্ণপদক পান। ১৯৯০ সালে টিভি নাটকের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য টেনাশিনাস পদক লাভ করেন। চিত্রশিল্প, নাট্য নির্দেশক এবং পাপেট নির্মাণে অবদানের জন্য শিশু কেন্দ্র থেকে ২০০২ সালে বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। চারুকলার গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।

ব্যাক্তিগত জীবনে এই গুণী শিল্পী ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহ এর মেয়ে মেরীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী মেরী পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকা মিউজিক কলেজের প্রিন্সীপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন ছিলেন। শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান জনক। পুত্র সাহদত মনোয়ার বাংলাদেশ বিমানের পাইলট এবং কন্যা নন্দিনী মনোয়ার একটি এনজিওতে কর্মরত। বাংলাদেশী অস্কারজয়ী অ্যানিমেটর নাফিস বিন জাফর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র। গতকাল ছিলো প্রতিবাদী শিল্পী মুস্তফা মনোয়ারের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। সৃজনী ও উদ্ভাবনী প্রতিভার প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ারের জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।

সকল ছবি: সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী


Previous Post Next Post

نموذج الاتصال