রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কীভাবে হলো, কেমন চলছে



ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান মন্দির। ছবি: প্রথম আলো

‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র আদর্শ নিয়ে ধর্ম ও জনহিতকর নানা কাজ করে চলেছে ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রাচীন সংগঠন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯১৬ সালে। তবে সূচনাপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরও আগে।

সাধারণভাবে লোকমুখে প্রতিষ্ঠানটি ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ নামেই পরিচিত। গত সপ্তাহে মিশনে গিয়ে দেখা গেল ভেতরের চমৎকার দৃশ্য। উত্তর প্রান্তের প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে হাতের ডানে, অর্থাৎ পশ্চিম পাশে স্কুল, চিকিৎসাকেন্দ্র, হোমিও চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ কেন্দ্র, মিলনায়তন, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ও বেদান্ত সাহিত্য প্রচার ও বিপণন কেন্দ্র এবং পাঠাগারের বহুতল ভবন। সামনে খোলা মাঠ। পূর্ব দিকে ‘বিবেকানন্দ ভবন’।

সামনে স্থাপিত স্বামীজির আবক্ষ মূর্তি। এখানে আছে ছাত্রদের আবাসন, প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদি। এই ভবনের সামনের খোলা জায়গায় মৌসুমি ফুলের বাগান। এটি মিশনের সামনের অংশ।

মূল মন্দির বিবেকানন্দ ভবনের পরের অংশে। বেশ দূর থেকে এর সুদৃশ্য চূড়া চোখে পড়ে। সামনে নৃত্যরত নটরাজের বিশাল মূর্তি। এরপরে রয়েছে সাধুদের আবাসন, রান্নাঘর, সবুজ ঘাসে ছাওয়া একটুকরা খোলা মাঠ। আর দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে পুকুর। পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু।

অতীত দিনের কথা

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আদর্শে অনুপ্রাণিত স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠাতা। মিশনের প্রধান আদর্শ–উদ্দেশ্য চারটি। ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র কথা তো আগেই বলা হয়েছে। অন্য তিনটি হলো—সব ধর্মকে এক অক্ষয় সনাতন সত্যের প্রকাশ জেনে সব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন। সব ধর্মের মহাপুরুষদের সম্মান জানানো এবং শিক্ষার বিস্তার করে জনসাধারণের জীবনমান উন্নত করা।

ব্রিটিশ পূর্ববঙ্গের ঢাকায় মিশনের কার্যক্রম চালুর জন্য ১৮৯৯ সালের প্রথম দিকে স্বামী বিবেকানন্দ স্বামী বিরোজানন্দ ও স্বামী প্রকাশানন্দকে মনোনীত করেন। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁরা ঢাকায় আসেন। উঠেছিলেন জমিদার মোহিনীমোহন দাসের ফরাশগঞ্জের বাড়িতে। সেখানেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন গঠনের অধিবেশন হয়েছিল।

ঢাকায় রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে মিশন থেকে প্রকাশিত ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন ঢাকা-র ইতিহাস’ নামের পুস্তিকায়। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, মোহিনীমোহন দাসের বাড়ির অস্থায়ী কার্যালয় থেকেই প্রাথমিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। প্রথমে কেবল ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আলোচনার মধ্যে কাজ সীমিত ছিল।

১৯০৮ সাল থেকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মাধ্যমে এর সেবা বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। স্বামী পরমানন্দের প্রচেষ্টায় পাঠাগার কার্যক্রম চালু হয়েছিল ১৯১১ সালে। ১৯১৩ সালে ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ মিশনের কার্যালয় হিসেবে বিনা ভাড়ায় একটি বাড়ির ব্যবস্থা এবং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাসিক অনুদানের ব্যবস্থা করেন। এই বাড়িতেই দুস্থ রোগীদের জন্য ইনডোর হাসপাতাল চালু করা হয়েছিল। নবাব পরিবারের সঙ্গেও মঠের সম্পর্ক সম্প্রীতির সম্পর্ক ছিল।

পরবর্তী সময় জমিদার শ্রীযোগেশ দাস ১৯১৪ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের স্থায়ী কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সাত হাজার টাকায় সাত বিঘা জমি কিনে দান করেন। এরই জমির সঙ্গে আরও কিছু জমি কেনা হয় মঠ ও মিশনের ভবন, সাধু নিবাস ও হাসপাতাল নির্মাণের জন্য। সেই বছরই মঠের ব্যবস্থাপনায় স্কুল চালু করা হয়েছিল। ১৯১৬ সালে এখানে ২০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়। গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এর দ্বারোদ্‌ঘাটন করেছিলেন।

একই বছর ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার কেন্দ্রীয় বেলুড় মঠের শাখা হিসেবে অনুমোদ লাভ করে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সব সন্যাসীকে আটক করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তখন মিশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, যিনি জে সি দেব নামেই খ্যাত। তিনি ১৯৭১ সালে শহীদ হয়েছিলেন।

ঢাকার মিশনের পক্ষ থেকে জানানো হলো, ঢাকার মঠটি ছাড়াও এখন সারা দেশে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বেলুড় মঠের অনুমোদনপ্রাপ্ত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে আরও ১৪টি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া ভক্তদের পরিচালিত আশ্রম রয়েছে ১১০টি। এগুলো বেলুড় মঠের অনুমোদন না পেলেও তাদের ভাবধারাতেই পরিচালিত হয়। সব মিলিয়ে মোট কেন্দ্র প্রায় ১২৫টি।

স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকায় আগমন

স্বামী বিবেকানন্দ ঢাকায় এলেও রামকৃষ্ণ মিশনে আসেননি। কারণ, তখন মিশনের নিজস্ব ভবন ছিল না। স্বামীজি ট্রেনে করে গোয়ালন্দ ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকায় আসেন ১৯০১ সালের ১৯ মার্চ। তিনিও জমিদার মোহিনীমোহন দাসের বাড়িতে উঠেছিলেন। এখানে তিনি বিকেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনা করতেন। তা ছাড়া জগন্নাথ কলেজ ও পোগজ স্কুলে দুটি সভায় ভাষণ দিয়েছিলেন।

মূল মন্দির

মিশনের আদি মন্দিরটি আর নেই। পুরোনো মন্দির সংস্কার করে ২০০৫ সালে নতুন মন্দির তৈরি করা হয়। প্রধান মন্দিরটি খিলানযুক্ত ষড়ভূজাকৃতির। প্রায় ৮০ ফুট উঁচু। মাঝখানে প্রায় দশতলা বাড়ির মতো উঁচু প্রধান চূড়া। এর সঙ্গে আছে আরও ছয়টি চূড়া। এসব চূড়ায় বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর প্রতীক স্থাপনের মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণের ভাব ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এ ছাড়া মন্দিরের সামনের ছাদে নৃত্যরত নটরাজের একটি বড় আকারের বিগ্রহ স্থাপন করা হয়েছে।

এই মন্দিরে একত্রে প্রায় ৫০০ ভক্ত বসতে পারেন। গর্ভ মন্দিরের তিন দিকে আছে বড় আকারে কাচের দরজা। ভেতরে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তি, শ্রী মা সারদা দেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের আলোকচিত্র। মন্দির বাইরের দেয়াল ধর্মীয় অলংকরণ যুক্ত।

পূজা-অর্চনা

মঠ সূত্র জানায়, এখানে ধর্মীয় পূজা-অর্চনার মধ্যে প্রতিদিন নিত্যপূজা ছাড়াও সারা বছরে ২৭টি তিথি-কৃত্য ও ৭টি পূজা-কৃত্য পালিত হয়। প্রতি একাদশী তিথিতে হয় রামনাম সংকীর্তন। এ ছাড়া নিয়মিত আন্তধর্মীয় সংলাপ, যোগ ও মেডিটেশন নিয়ে ক্লাস এবং বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন ধর্মের প্রধান ও বিশেষ মাহাত্মাদের জন্মদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে উদ্‌যাপন করা হয়। আর প্রতিদিন দুপুরে জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে শতাধিক ভক্তকে প্রসাদ দেওয়া হয়।

বিদ্যালয়: শুরুতে ছিল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২০০৮ সাল থেকে উচ্চবিদ্যালয় করা হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রাবাসে ৭০ জন শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থাসংবলিত ছাত্রাবাস রয়েছে বিবেকানন্দ ভবনে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের এখানে সীমিত খরচে থাকার সুবিধা রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাঠাগারটি ধ্বংস হয়ে যায়। এটি ১৯৭৩ সালে নতুন করে সংস্কার করা হয়। এখানে বইয়ের সংগ্রহ ১২ হাজার, পত্রিকা ও সাময়িকী রাখা হয় ৬০টির বেশি।

জনকল্যাণকর কার্যক্রম: রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে স্বল্পশিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসাকেন্দ্রে বছরে প্রায় এক লাখ মানুষকে স্বল্প বা বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আর্তজনের মধ্য ত্রাণ বিতরণ করা ছাড়াও অনেককে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়।

সূত্র: প্রথম আলো
Previous Post Next Post

نموذج الاتصال